শূদ্রদের বেদাধিকার সমন্ধ্যে সবচেয়ে অধিক প্রচলিত শঙ্কা এই যে, বেদান্তদর্শনে শূদ্রদের জন্য বেদ পাঠের অনধিকার দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এই আরোপ টি মহর্ষি ব্যাসদেবের উপর বর্তায় সেহেতু আমাদের এই শঙ্কার সমাধান অতি জরুরী। কারণ ব্যাসদেবের মতো মহান বেদজ্ঞ দ্বারা এরূপ জাতিভেদের সমর্থন কখনো সম্ভব নয়। তাই সূত্রটির উপর আমাদের বিস্তারিত আলোকপাত প্রয়োজন। শঙ্কাকৃত সূত্রটি হচ্ছে -
শ্রবণাধ্যয়নার্থপ্রতিষেধাত্ স্মৃতেশ্চ।।
(বেদান্তঃ ১।৩।৩৮)
উক্ত সূত্রের ভাষ্য শঙ্করাচার্য্য এরূপ করেছেন -
ইতশ্চ ন শূদ্রস্যাধিকারঃ; যদস্য স্মৃতেঃ শ্রবণাধ্যযনার্থপ্রতিষেধো ভবতি৷ বেদশ্রবণপ্রতিষেধঃ, বেদাধ্যযনপ্রতিষেধঃ, তদর্থজ্ঞানানুষ্ঠানযোশ্চ প্রতিষেধঃ শূদ্রস্য স্মর্যতে৷ শ্রবণপ্রতিষেধস্তাবত্ -- 'অথ হাস্য বেদমুপশ্রৃণ্বতস্ত্রপুজতুভ্যাং শ্রোত্রপ্রতিপূরণম্' ইতি; 'পদ্যু হ বা এতচ্ছমশানং যচ্ছূদ্রস্তস্মাচ্ছূদ্রসমীপে নাধ্যেতব্যম্' ইতি চ৷ অত এবাধ্যযনপ্রতিষেধঃ; যস্য হি সমীপেপি নাধ্যেতব্যং ভবতি, স কথমশ্রুতমধীযীত৷ ভবতি চ বেদোচ্চারণে জিহ্বাচ্ছেদঃ, ধারণে শরীরভেদ ইতি৷ অত এব চার্থাদর্থজ্ঞানানুষ্ঠানযোঃ প্রতিষেধো ভবতি -- 'ন শূদ্রায মতিং দদ্যাত্' ইতি, 'দ্বিজাতীনামধ্যযনমিজ্যা দানম্' ইতি চ৷ যেষাং পুনঃ পূর্বকৃতসংস্কারবশাদ্বিদুরধর্মব্যাধপ্রভৃতীনাং জ্ঞানোত্পত্তিঃ, তেষাং ন শক্যতে ফলপ্রাপ্তিঃ প্রতিষেদ্ধুম্, জ্ঞানস্যৈকান্তিকফলত্বাত্৷ 'শ্রাবযেচ্চতুরোবর্ণান্ ' ইতি চেতিহাসপুরাণাধিগমে চাতুর্বর্ণ্যস্যাধিকারস্মরণাত্৷ বেদপূর্বকস্তু নাস্ত্যধিকারঃ শূদ্রাণামিতি স্থিতম্৷৷
ভাষ্যার্থঃ
শূদ্রদের বিদ্যায় অধিকার নেই, কারণ স্মৃতি তাহার জন্য শ্রবণ, অধ্যয়ন এবং অর্থের নিষেধ করে। স্মৃতিতে শূদ্রদের জন্য বেদের শ্রবণ, বেদের অধ্যয়ন এবং বেদার্থের জ্ঞান এবং অনুষ্ঠানের নিষেধ। অথাস্য বেদমুপ (সমীপে বেদের শ্রবণ কারীর দুই কাণে সীসা এবং লোহা ভরে দাও) এবং "পদ্যু হ বা এতচ্ছমশানং" (শুদ্র নিঃসন্দেহে জঙ্গম শশ্মান, এইজন্য শূদ্রের সমীপে অধ্যয়ন করা উচিত নয়) যদি শূদ্র বেদের উচ্চারন করে তো তার জিহ্বা কেটে দেওয়া উচিৎ এবং বেদের স্মরণ করে তো তার শরীর টুকরো টুকরো করে দেওয়া উচিৎ। " ন শুদ্রায়" (ব্রাহ্মণের উচিৎ শূদ্রকে বেদার্থজ্ঞান না দেওয়া)
[ শাঙ্করভাষ্যের হিন্দি অনুবাদ ]
শ্রবণাধ্যয়নার্থপ্রতিষেধাত্ স্মৃতেশ্চ।।
(বেদান্তঃ ১।৩।৩৮)
উক্ত সূত্রের ভাষ্য শঙ্করাচার্য্য এরূপ করেছেন -
ইতশ্চ ন শূদ্রস্যাধিকারঃ; যদস্য স্মৃতেঃ শ্রবণাধ্যযনার্থপ্রতিষেধো ভবতি৷ বেদশ্রবণপ্রতিষেধঃ, বেদাধ্যযনপ্রতিষেধঃ, তদর্থজ্ঞানানুষ্ঠানযোশ্চ প্রতিষেধঃ শূদ্রস্য স্মর্যতে৷ শ্রবণপ্রতিষেধস্তাবত্ -- 'অথ হাস্য বেদমুপশ্রৃণ্বতস্ত্রপুজতুভ্যাং শ্রোত্রপ্রতিপূরণম্' ইতি; 'পদ্যু হ বা এতচ্ছমশানং যচ্ছূদ্রস্তস্মাচ্ছূদ্রসমীপে নাধ্যেতব্যম্' ইতি চ৷ অত এবাধ্যযনপ্রতিষেধঃ; যস্য হি সমীপেপি নাধ্যেতব্যং ভবতি, স কথমশ্রুতমধীযীত৷ ভবতি চ বেদোচ্চারণে জিহ্বাচ্ছেদঃ, ধারণে শরীরভেদ ইতি৷ অত এব চার্থাদর্থজ্ঞানানুষ্ঠানযোঃ প্রতিষেধো ভবতি -- 'ন শূদ্রায মতিং দদ্যাত্' ইতি, 'দ্বিজাতীনামধ্যযনমিজ্যা দানম্' ইতি চ৷ যেষাং পুনঃ পূর্বকৃতসংস্কারবশাদ্বিদুরধর্মব্যাধপ্রভৃতীনাং জ্ঞানোত্পত্তিঃ, তেষাং ন শক্যতে ফলপ্রাপ্তিঃ প্রতিষেদ্ধুম্, জ্ঞানস্যৈকান্তিকফলত্বাত্৷ 'শ্রাবযেচ্চতুরোবর্ণান্ ' ইতি চেতিহাসপুরাণাধিগমে চাতুর্বর্ণ্যস্যাধিকারস্মরণাত্৷ বেদপূর্বকস্তু নাস্ত্যধিকারঃ শূদ্রাণামিতি স্থিতম্৷৷
ভাষ্যার্থঃ
শূদ্রদের বিদ্যায় অধিকার নেই, কারণ স্মৃতি তাহার জন্য শ্রবণ, অধ্যয়ন এবং অর্থের নিষেধ করে। স্মৃতিতে শূদ্রদের জন্য বেদের শ্রবণ, বেদের অধ্যয়ন এবং বেদার্থের জ্ঞান এবং অনুষ্ঠানের নিষেধ। অথাস্য বেদমুপ (সমীপে বেদের শ্রবণ কারীর দুই কাণে সীসা এবং লোহা ভরে দাও) এবং "পদ্যু হ বা এতচ্ছমশানং" (শুদ্র নিঃসন্দেহে জঙ্গম শশ্মান, এইজন্য শূদ্রের সমীপে অধ্যয়ন করা উচিত নয়) যদি শূদ্র বেদের উচ্চারন করে তো তার জিহ্বা কেটে দেওয়া উচিৎ এবং বেদের স্মরণ করে তো তার শরীর টুকরো টুকরো করে দেওয়া উচিৎ। " ন শুদ্রায়" (ব্রাহ্মণের উচিৎ শূদ্রকে বেদার্থজ্ঞান না দেওয়া)
[ শাঙ্করভাষ্যের হিন্দি অনুবাদ ]
এখন আমাদের প্রশ্ন এই যে, বেদ কি তবে কারো একচেটিয়া সম্পত্তি? ঈশ্বর কি শুধুমাত্র এককভাবে কোন জাতিকে বেদ জ্ঞান দিয়েছেন? আসুন তবে বেদ হতেই দেখে নেওয়া যাক -
যথেমাং বাচং কল্যানীমাবদানিজনেভ্যঃ।ব্রহ্ম রাজান্যাভ্যাং শূদ্রায়চার্যায় চ স্বায় চারণায় চ।প্রিয়ো দেবানংদক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভুয়াসময়ং মে কামংসমৃধ্যতামুপ মাদো নমতু।।
(যজুর্বেদ ২৬।২)
অর্থাৎ পরমেশ্বর সব মনুেষ্যর প্রতি উপদেশ দিচ্ছেন - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র,বৈশ্য, স্বীয় স্ত্রীর ও সেবকাদি এবং অন্যান্য সকল মনুষ্যকেই যেমন আমি এই মঙ্গলদায়িনী বেদবাণীর উপদেশ দান করিয়াছি, তোমরাও সেইরুপ করো।
বেদ মন্ত্রে স্পষ্ট যে, ঈশ্বর ব্রাহ্মণ, শূদ্র, বৈশ্য, শুদ্র, নারী, সেবক অর্থাৎ সর্ব জাতি নির্বিশেষে বেদ জ্ঞানের উপদেশ দিয়েছেন। সেহেতু বেদ জ্ঞানে সবার অধিকার রয়েছে। যেখানে ঈশ্বর সবাইকে বেদ জ্ঞানের অধিকার দিয়েছে সেখানে সূত্রের এরূপ অর্থ বেদ বিরুদ্ধ। আর আমাদের এরুপ বেদ বিরুদ্ধ অর্থ অভিপ্রেত নয়। তাই সূত্রটির সত্যার্থ জানা প্রয়োজন। আসুন সূত্রগুলোর উপর ক্রমান্বয়ে আলোচনা করা যাক -
সংস্কারপরামর্শত্ তদভাবাভিষাপাত্।।
(বেদান্তঃ ১।৩।৩৬)
(সংস্কারপরামর্শত্) শাস্ত্রের অধ্যয়নে যে উপনয়ন সংস্কারের অভিসম্বন্ধ বলা হয়েছে, ইহাতেই বিচারের প্রসঙ্গ কিন্তু যখন (তদভাবাভিলাপাত্) তার অভাবের অভিলাপন, বর্ণনা মেলে, যেমন " তং হোপনিন্যে" (শতপথ ১১।৫।৩।১৩) এখানে তো উপনয়ন সংস্কারের বর্ণনা যে তার উপনয়ন করবে। কিন্তু "তান্ হানুপনীয়ৈতদুবাচ" (ছান্দোঃ ৫।১১।৭) প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ আদিকে কৈকয় অশ্বপতি বৈশ্বানর বিদ্যার উপদেশ বিনা উপনয়নে দিয়ছেন। অতঃ উপনয়ন সংস্কার না করেও ব্রহ্মবিদ্যার উপদেশ দেওয়া যায়। ব্রহ্মবিদ্যা অধিকারে উপনয়ন সংস্কার প্রতিবন্ধক নয়।।৩৬।।
উচ্চ এবং নিচ বর্ণের কারণ গুণ এবং কর্মই, জন্ম নয়। ইহাতে উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে -
তদভাবনির্ধারণে চ প্রবৃত্তেঃ।।
(বেদান্তঃ ১।৩।৩৭)
(তদভাবনির্ধারণে চ) অধ্যয়নবিরোধী গুণ কর্মের অভাবের নির্ধারণ করেও (প্রবৃত্তেঃ) অধ্যাপনবৃত্তির প্রাপ্ত গুণ কর্মই উচ্চ এবং নিচ বর্ণের কারণ। ছান্দোগ্যপনিষদে এসেছে যে, সত্যকাম জাবাল হারিদ্রমত গৌতম আচার্যের কাছে গিয়ে বললেন - আমি আপনার সেবায় ব্রহ্মচর্য্যবাস করবো, আপনি আমাকে উপনয়ন করুণ তাহাতে আচার্য্য জিজ্ঞেস করলেন তোমার গোত্র কি? উত্তরে সত্যকাম বললেন আমি জানি না আমার গোত্র কি। মাতা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি উত্তর দিয়েছেন - যৌবন কালে বহু লোকের পরিচর্যায় থেকে তোমাকে প্রাপ্ত করেছি, আমি জানি না তোমার গোত্র কি। ইহা শুনে আচার্য্য তার উপনয়ন করলেন। এই প্রকার অজ্ঞান কুলে উৎপন্নের বিদ্যাধ্যয়নে অধিকার যে গুণের অনুসারে এখানে তারই প্রদর্শিত করা হয়েছে। সত্যভাষণ এখানে গুণ বিদ্যার অধ্যয়নে দেখানো হয়েছে।। ৩৭।।
শ্রবণাধ্যয়নার্থপ্রতিষেধাত্ স্মৃতেশ্চ।।
(বেদান্তঃ ১।৩।৩৮)
(শ্রবণাধ্যনার্থপ্রতিষেধাত্) গুণ কর্ম রহিত কোন বর্ণের জন্য শ্রবণ অধ্যয়ন প্রতিষেধ প্রাপ্ত হওয়ার কারণে " নাপ্রশান্তায় দাতব্যং নাপুত্রাশিষ্যায় বা পুনঃ" (শ্বেতাঃ ৬।২২) অর্থাৎ অশান্ত, অযোগ্য পুত্রকে এবং শিষ্যত্বরহিত কে বিদ্যা দেওয়া উচিৎ নয়। "নৈতদচীর্ণব্রতোহধীতে" (মুন্ডক ৩।২২।১১) ব্রতচারণ রহিত জনকেও পাঠের অধিকার নেই। (স্মৃতে চ) স্মৃতিতেও গুণহীনের জন্যও অধ্যয়নের প্রতিষেধ দেখানো হয়েছে।
বিদ্যা হৈ বৈ ব্রাহ্মণমাজগাম গোপায় মা শেবধিষ্টহহমস্মি।
অসুয়কায়ানৃজবেহয়তায় ন মা ব্রূয়া বীর্যবতী তথা স্যাম্।।
(নিরুক্ত ২।৪ এবং মনুস্মৃতি ২।১১৪)
বিদ্যা ব্রহ্মণের পাশ গিয়ে বললেন - "আমি তোমার কোষ আমার রক্ষা করো। নিন্দক, অসরল, অসংযমীর জন্য আমার উপদেশ করো না যাতে আমি বলবতী হতে পারি।
মহাভারতে আরো স্পষ্টরূপে বলা হয়েছে যে বেদ উপদেশ কাদের জন্য নয় -
নাবেদনিষ্ঠস্য জনস্য রাজন প্রদেয়মেতত্ পরমং ত্বয়্ ভবেত্
বিধিত্সমানায় বিবোধকারণং প্রবোধহেতোঃ প্রণতস্য শাসনম্।।
(মহাঃ শান্তিঃ ৩০৮। ৩২)
যে মনুষ্য বেদে শ্রদ্ধা রাখে না, তাকে এই জ্ঞানের উপদেশ করা উচিৎ নয়। যার বোধের জন্য অধিক পিপাসা তথা যে জিজ্ঞাসু শরণে আসে তিনিই শোনার অধিকারী।
পৃথ্বীমিমাং যদ্যপি রত্নপূর্ণা দদ্যান্ন দেয়ং ত্বিদমব্রতায়।
জিতেন্দিয়ায়ৈতদসংশয়ং তে ভবেৎ প্রদেয়ং পরমং নরেন্দ্র।।
(মহাঃ শান্তিঃ ৩০৮।৩৭)
নরেন্দ্র! যিনি ব্রত এবং নিয়মের পালন করে না। তিনি যদি রত্ন দ্বারা পূর্ণ এই সারা পৃথিবীর রাজ্য দেয় তবুও তাকে জ্ঞান উপদেশ দেওয়া উচিৎ নয়। পরন্তু জিতেন্দ্রিয় পুরুষকে নিসন্দেহ এই পরম উত্তম জ্ঞানের উপদেশ দেওয়া তোমাকে উচিৎ।।
অতঃএব অধ্যয়নে চার বর্ণেরই অধিকার, গুণহীন কোন বর্ণের ব্যক্তিরই অধিকার নেই। এই প্রকার অধ্যয়নে যোগ্য মনুষ্যমাত্রের অধিকার জানানোর জন্য এই বর্ণনা জানা উচিৎ না কি শুদ্ধাধ্যয়নপ্রতিষেধের জন্য?
এই সূত্রের শঙ্করভাষ্যে বেদের শ্রবণ কারী শূদ্রের কর্ণে সীসের ধাতু, বেদের উচ্চারণ কারীকে জিহ্বাচ্ছেদন করা, বেদের স্মরণ কারীর শির কেটে ফেলার প্রতিপাদন এবং তার স্বীকার শঙ্করাচার্যের মতো মহান বিদ্বান দ্বারা করা বড়ই আশ্চর্য্য এবং অনর্থের বিষয়। " অহম ব্রহ্মাস্মি = আমি ব্রহ্ম, জীব ব্রহ্মের একতার কথার স্বীকার এবং প্রচারকারী শঙ্করাচার্যের শূদ্রদের প্রতি এই প্রকার নির্দয়তা এবং সুত্রকার ব্যসমুনির সিদ্ধান্তের এরূপ অর্থ করে ব্যাসমুনিকে প্রশ্নচিহ্ন তোলার সুযোগ দিয়েছেন।
0 মন্তব্য(গুলি)