ছান্দোগ্যের এই সন্দর্ভের অর্থ এই প্রকার - হে সোম্য! এই প্রজার সৎকারণ, সৎ আশ্রয়সম্পন্ন এবং সৎ এ প্রতিষ্ঠিত। এখানে যা কিছু, তাহা নিজ স্বরূপে সৎ। অর্থাৎ মিথ্যা কিছু নয়।
ঈশাবাস্যোপনিষদর শান্তিপাঠে বলা হয়েছে -
পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণ্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।
- সরলার্থঃ তিনি [ব্রহ্ম] পূর্ণ এই জগৎ ও পূর্ণ [কারণ] পূর্ণ ব্রহ্ম থেকেই পূর্ণ জগৎ উদিত হয়। এই পূর্ণ জগতের পূর্ণ কে নিয়ে নিলে পূর্ণ ব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকে।।
এই সন্দর্ভের সার প্রথম দুই পদে নিহিত, শেষ সব তারই ব্যাখ্যা। ওই দুই পদ হচ্ছে - "অদস" এবং "ইদম্"।
"অদস্" পরোক্ষ "ইদম্" প্রত্যক্ষ। "অদস্ " চেতন "ইদম্" অচেতন, জড়। "অদস" পরোক্ষ পরব্রহ্ম পরমাত্মা, "ইদস্" প্রত্যক্ষ অচেতন (জড়) অগণিত লোক - লোকান্তরের রূপে ছড়িয়ে পড়া বিশ্ব। সন্দর্ভে বলা হয়েছে - পূর্ণ অদঃ পূর্ণ ইদম্, অদস্ পূর্ণ, ইদম্ পূর্ণ। নিজ নিজ স্বরূপে অবস্থিত উভয়েই পূর্ণ, কারো কোন ন্যুনতা নেই। এইজন্য "অদস" পূর্ণের অন্তর্গত ও "ইদম্" পূর্ণ স্বরূপ তাহা থেকে পৃথক। উভয়ের পূর্ণ এবং স্বতন্ত্র হওয়ার কারণে উভয়েই সত্য, মিথ্যা কেউ নয়।
কোনও বস্তুর সত্য হওয়া তার সাধক প্রমাণের হওয়া এবং বাধক প্রমাণের না হওয়ার উপর নির্ভর করে। এই রূপে জগৎ এক যথার্থ সত্তা। তাকে মিথ্যা বলা অসংগত। ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির মূল উপাদান তত্ব দ্বারা জীবাত্মার ভোগ তথা অপবর্গের সিদ্ধির জন্য জগতের প্রাদুর্ভাব। চেতন আত্মতত্ত্ব তথা প্রকৃতি উভয়ই নিত্য -- সত্য। তখন সদ্ ব্রহ্ম দ্বারা সেই উভয়কে মিলিয়ে নির্মিত জগৎ মিথ্যা কিভাবে হতে পারে? মূল উপাদান দ্বারা উৎপন্ন হওয়ার কারণে জগতের বাস্তবিকতার অপলাপ কিভাবে করা যেতে পারে? যখন উপাদান সত্য তখন তাহার বিকার কে মিথ্যা বা কল্পিত বলা যেতে পারে না। যদি স্বর্ণ সত্য হয় তখন তা থেকে নির্মিত অঙ্গুরি কিভাবে মিথ্যা হতে পারে? সংসারের পৃষ্ঠভূমির মধ্যে এক গম্ভীর আশয় নিহিত। এইজন্য তাকে কেবল ভ্রান্তিমাত্র বলে পরিহাসের বস্ত মানা যেতে পারে না।
সত্য এবং মিথ্যা সাপেক্ষ শব্দ। যখন আমরা চোখের সমানে বিস্তার জগৎ কে মিথ্যা বলি তবে কোন না কোন অথবা কোথাও না কোথাও সত্য জগৎ এর সাপেক্ষ থেকেই বলি। যখন আমার হাতে রাখা স্বর্ণ কে নকল বলি তো কোথাও না কোথাও দেখা আসল স্বর্ণের সাপেক্ষ থেকেই বলি। এই প্রকার কোথাও না কোথাও সত্য দেখা জগতের আধারের উপরই বর্তমান জগৎ কে মিথ্যা বলা হয়ে থাকে।
নবীন বেদান্তি এবং শঙ্করাচার্য্য কার্য এবং কারণ অনন্যত্ব মানে। অতএব যদি ব্রহ্ম সত্য, অর্থাৎ যদি জগতের কারণরূপ ব্রহ্ম সত্য হয় তখন তার কার্য্যরূপ জগৎ মিথ্যা হতে পারে না। কারণরূপ ব্রহ্মের কার্যরূপ জগৎ থেকে অন্যত্ব মানা যায় যদি জগৎ কে মিথ্যা মানা যায় তো স্বয়ং ব্রহ্মও মিথ্যা হয়ে যায়। কিন্তু ব্রহ্মর সত্যের হওয়া নির্বিবাদ। এইজন্য তার কার্যরূপ জগতের সত্য হওয়া স্বতঃ সিদ্ধ।
জগতের মিথ্যা সিদ্ধ করার জন্য সহায়ক প্রায়ঃ দুই দৃষ্টান্ত দেখা যায় - স্বপ্নবত তথা রজ্জু সর্পবত। স্বপ্নে আত্মার সম্বন্ধ মনে থেকে যায়। যে সংস্কার জাগ্রত দশায় ইন্দ্রিয়ের উপর পড়ে, তাহাই নিদ্রাকালে পরিস্ফুট হয়। এর নামই স্বপ্ন। বাস্তবে স্বপ্নদর্শন স্মৃতিরূপ। জাগ্রত কালের অনুভবের স্মৃতি দ্বারাই স্বপ্নের নির্মাণ হয়। যেই প্রকার প্রত্যক্ষের বিনা অনুমান হয় না, সেই প্রকার জাগ্রত কালে অনুভবের স্মৃতি বিনা স্বপ্ন হয় না। সংস্কার বিনা স্মৃতি হয় না। কোন বস্তু বা ব্যবহারের অনুভব হওয়ার পর তার সংস্কার মনে নির্মিত হয়, অর্থাৎ যা কিছু আমরা দেখি শুনি, তাহার ছাপ আত্মার উপর পড়ে, তাকেই সংস্কার বলে। এই প্রকার স্বপ্ন আধারভূত সংস্কার এবং তজ্জন্য স্মৃতি উভয়ের প্রথম অনুভবকৃত পদার্থের বিষয়ে হয় যা কেবল জাগ্রত দশায় সম্ভব। বিনা দেখা শোনা বা অনুভব করা জিনিষ , স্বপ্নে দেখা, শোনা বা অনুভব করা সম্ভব নয়।
অদ্বৈতমতের মান্যতা যে, অন্ধকারে রজ্জু সর্প দৃষ্ট হয়, ওইরূপ ব্রহ্ম কোন প্রকারের বিকারে আসার ফলে জগৎরূপ হয়েছেন। যেমন প্রকাশের পর সর্প লোপ হয়ে যায় আর কেবল রজ্জুই থাকে, ওইরূপ জ্ঞান হওয়ার পর জগৎ এর লোপ হওয়ার পর ব্রহ্মই থাকে।
এই প্রকার প্রতীতির দার্শনিক ভাষায় অধ্যাস বা বিবর্ত্ত তথা সামান্য ভাষাতে ভ্রম বলে। ভ্রান্তির জন্য তিন কথা আবশ্যক - পূর্বদৃষ্টি, তার সংস্কার এবং পরত্র। আমরা যদি বাস্তবিক সর্প দেখি তা আমাদের পূর্বদৃষ্টি। তার সংস্কার আমাদের মধ্যে স্মৃতিরুপ ধারণ করে। বর্তমানে প্রস্তুত রজ্জু পরত্র যা পূর্বদৃষ্টির স্মৃতির কারনে সর্পের ভাব হয়েছে। রজ্জুতে সর্পের ভ্রম হওয়া সম্ভব নয় যদি কেউ কখনো বাস্তবিক সর্প না দেখে থাকে। তখন সর্প কে অসত বা অবস্তু মানা যেতে পারে না। যদি কোথাও না কোথাও কখনো বা কখনো সর্পের সদ্ভাব না হতো তো এখন সেই ভ্রম কোথা থেকে এলো? ভ্রান্তি কোন না কোন কারনেই হয়ে থাকে। সর্প নামের কোন বস্তু যদি বাস্তবিক না হয় তবে সর্পের ভ্রান্তি কি করে হতে পারে? যদি ব্রহ্মের অতিরিক্ত কোন সত্তাই নেই তো যদি বলা যায় - ব্রহ্মের , জগতের ভ্রান্তি হয় অজ্ঞানের কারণে। অন্য শব্দে স্বয়ং ব্রহ্ম নিজে নিজেকে জগৎ মনে করে ভূল করে। তা মানা অসঙ্গত। কারণ ব্রহ্ম নিজের স্বরুপ ভূলে অন্ধকারে রজ্জুকে সর্প মনে করছে এই প্রকার ভ্রান্তি সর্বজ্ঞ ব্রহ্মের হতে পারে না। তা একমাত্র অল্পজ্ঞ জীবেরই হতে পারে।
[এই লেখা স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী জীর পুস্তক "অদ্বৈতমত খন্ডন" এর সার প্রস্তুত। এই পুস্তক স্বামী দয়ানন্দ জীর "বেদান্ত - ধ্বান্ত - নিবারনম্ " এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা ]
Advaitavadis also preach that their is advaita in Mandukya Upanishad.
ReplyDelete