অতি সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে রামকৃষ্ণ কথামৃত দ্বারা মহর্ষি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীজীর জ্ঞানের ওপর প্রশ্ন তোলার দুঃসাহস কিছু অবোধ শিশুগণ করছেন । তাদের ন্যূন জ্ঞান দ্বারা তারা বিবিধ অপ্রামাণিক ও সাম্প্রদায়িক পুস্তক দ্বারা এহেন সিদ্ধান্ত প্রচার করে আত্মতুষ্টিতে ভোগে । কদাচিৎ তারা স্মরণ রাখে যে , যে পুস্তক নিজস্ব সম্প্রদায়ের তাতে অন্যদের হেয় করার ষড়যন্ত্র বা মিথ্যাচার থাকতেই পারে । উপযুক্ত প্রমাণাদির পরিপ্রেক্ষিতে যা প্রমাণ করা সম্ভব । রামকৃষ্ণ মিশনের কথামৃতের যে অংশটি তারা তুলে ধরে তা নিম্নরূপ -
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২৬শে অক্টোবর
গৃহস্থাশ্রমকথা-প্রসঙ্গে — নির্লিপ্ত সংসারী
শ্রীযুক্ত মহিমাচরণাদি ভক্তেরা বসিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের হরিকথামৃত পান করিতেছেন। কথাগুলি যেন বিবিধ বর্ণের মণিরত্ন, যে যত পারেন কুড়াইতেছেন — কিন্তু কোঁচড় পরিপূর্ণ হয়েছে, এত ভার বোধ হচ্ছে যে উঠা যায় না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আধার, আর ধারণা হয় না। সৃষ্টি হইতে এ পর্যন্ত যত বিষয়ে মানুষের হৃদয়ে যতরকম সমস্যা উদয় হয়েছে, সব সমস্যা পূরণ হইতেছে। পদ্মলোচন, নারায়ণ শাস্ত্রী, গৌরী পণ্ডিত, দয়ানন্দ সরস্বতী ইত্যাদি শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতেরা অবাক্ হয়েছেন। দয়ানন্দ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে যখন দর্শন করেন ও তাঁহার সমাধি অবস্থা দেখিলেন, তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমরা এত বেদ-বেদান্ত কেবল পড়েছি, কিন্তু এই মহাপুরুষে তাহার ফল দেখিতেছি; এঁকে দেখে প্রমাণ হল যে পণ্ডিতেরা কেবল শাস্ত্র মন্থন করে ঘোলটা খান, এরূপ মহাপুরুষেরা মাখনটা সমস্ত খান।
[ রামকৃষ্ণ কথামৃত - ১ম খণ্ড ]
এখান থেকে বিরোধীগণ যে বিষয়টি তুলে ধরেন তা হল , মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে নিজের অজ্ঞতার জন্য আক্ষেপ করেছিলেন ।
মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমরা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেই উপরের কন্টেক্সট অনুযায়ী কোথাও মহর্ষি নিজেকে অজ্ঞ বা নিজের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেননি ।
👉 এবার আসি শ্রীম কথিত রামকৃষ্ণ কথামৃতের ইতিহাস নিয়ে -
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (যিনি "শ্রীম" ছদ্মনামে কথামৃত রচনা করেন ) ছিলেন কলকাতার রিপন কলেজের অধ্যাপক। ১৮৮২ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে তার আলাপ হয়। রামকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বে আকর্ষিত হয়ে মহেন্দ্রনাথ তার কথোপকথন ও কার্যকলাপের স্টেনোগ্রাফিক রেকর্ড রাখতে শুরু করেন নিজের ডায়েরিতে। এই রেকর্ডটিই পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত নামক বইয়ের আকার নেয়। প্রথম দিকে মহেন্দ্রনাথ যখন ডায়েরি লিখতে শুরু করেছিলেন, তখন তার সেটি প্রকাশের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। রচনাপদ্ধতি সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, "বাড়ি ফেরার পর স্মৃতি থেকে সব কিছু লিখে রাখতাম। মাঝে মাঝে সারা রাতও জেগে থাকতে হত...মাঝে মাঝে টানা সাত দিন বসে থেকে লিখতে হত। গানগুলিকে স্মরণে আনতে হত, কোন ক্রমে সেগুলি গাওয়া হয়েছিল, সেগুলিও মনে করতে হত, সমাধি ও অন্যান্য সব ঘটনার কথা মনে করতে হত।"
[ Tyagananda; Vrajaprana (২০১০)। Interpreting Ramakrishna: Kali's Child Revisited - http://www.interpretingramakrishna.com/toc.html - পৃষ্ঠা ৭-৮ ]
কথামৃত-এর প্রথম খণ্ড (১৯০২) প্রকাশের আগে আ লিফ ফ্রম দ্য গসপেল অফ শ্রীরামকৃষ্ণ (১৮৯৭) নামে একটি ছোট ইংরেজি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের মৃত্যুর পর তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে মহেন্দ্রনাথ নিজের ডায়েরিটি প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তিনি ভেবেছিলেন এর মাধ্যমে রামকৃষ্ণের চিন্তাভাবনার কথা সঠিকভাবে লোকসমক্ষে প্রচার করা যাবে। ডায়েরি প্রকাশের আগে তিনি সারদা দেবীর অনুমতিও নেন। ১৮৯৮ থেকে ১৯০২ সালের মধ্যে তাঁর ডায়েরির অংশবিশেষ বঙ্গদর্শন, উদ্বোধন, হিন্দু পত্রিকা, সাহিত্য পত্রিকা, জন্মভূমি প্রভৃতি প্রথম সারির সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়। প্রথম চারটি খণ্ড যথাক্রমে ১৯০২, ১৯০৪, ১৯০৮ ও ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয়। মহেন্দ্রনাথের অসুস্থতার জন্য পঞ্চম খণ্ডটির প্রকাশ বিলম্বিত হয়। অবশেষে ১৯৩২ সালে পঞ্চম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়। ১৯৩২ সালে মারা যাওয়ার আগে মহেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন ছয় বা সাতটি খণ্ড পর্যন্ত প্রকাশের পর তিনি গোটা বইটির বিষয়বস্তু কালানুক্রমিকভাবে সাজাবেন।
💥 অর্থাৎ, রামকৃষ্ণের সাথে শ্রীমের সাক্ষাৎ হয় ১৮৮২ সালে । এর আগে তিনি জানতেন না এবং কথামৃতে যা উল্লেখ আছে সবই সেই তারিখের ঘটনা । এই বিষয়ে আরো একটি প্রমাণ হল রামকৃষ্ণ কথামৃতে স্বয়ং গ্রন্থকারই স্বীকার করে বলেছেন -
▶' শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত চারি ভাগ প্রকাশিত হইল। শ্ৰীম-বা মাষ্টার বা M (a son of the Lord and servant ) একই ব্যক্তি। তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে থাকিয়া যে সকল ব্যাপার নিজের চক্ষে দেখিয়াছেন বা নিজের কর্ণে শুনিয়াছেন তাহাই এই গ্রন্থে বর্ণনা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন অন্য ভক্তদিগের নিকট শুনিয়া লিখেন নাই । গ্রন্থের উপকরণ সমস্তই তাহার দৈনন্দিন কাহিনী Diary লিপিবদ্ধ ছিল। যেই দিনে দেখিয়াছেন বা শুনিয়াছেন সেই দিনেই সমস্ত স্মরণ করিয়া Diaryতে লেখা হইয়াছিল । ' ◀
অর্থাৎ , ১৮৮৪ সালের উক্ত ২৬ অক্টোবরের ঘটনাও তার সম্মুখেই হওয়ার কথা এবং এর পক্ষে স্বয়ং গ্রন্থাকার স্বীকার করছেন । এখানে উক্ত ঘটনা স্মৃতি বা শুনে লেখা তার পক্ষে কোন প্রমাণ নেই ।
এবার আসুন মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বঙ্গ তথা কলকাতা ভ্রমণ প্রসঙ্গে । মহর্ষির সকল জীবনী অনুযায়ী ১৮৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তিনি কলকাতায় আসেন ও ১৮৭৩ সালের ১৬ই এপ্রিল কলকাতা ত্যাগ করেন ।
আবার মহর্ষি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীজী ৩০ অক্টোবর ১৮৮৩ (বয়স ৫৯) দেহত্যাগ করেন ।
তাহলে তার ১০ বছর পর ১৮৮৪ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে ওনার দেখা হয় কিভাবে ? ভূতের সাথে দেখা হয়েছিল কি ? যেভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলাম মতে সাধনা (?) করে জ্যোতির্ময় পুরুষ দেখেছিলেন ?
পরিশেষে শ্রীরামকৃষ্ণের বর্ণাশ্রম তথা জন্মগত বর্ণ নিয়ে আর ব্রাহ্মণ্যবাদের মান্যতার একটু সামান্য দৃষ্টান্ত দেখি -
শ্রীরামকৃষ্ণ — অদ্বৈতগোস্বামী বংশ, — আকরের গুণ আছেই!
“নেকো আমের গাছে নেকো আমই হয়। (ভক্তদের হাস্য) খারাপ আম হয় না। তবে মাটির গুণে একটু ছোট বড় হয়। আপনি কি বলেন?”
গোস্বামী (বিনীতভাবে) — আজ্ঞে, আমি কি জানি।
শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি যাই বল, — অন্য লোকে ছাড়বে কেন?
“ব্রাহ্মণ, হাজার দোষ থাকুক — তবু ভরদ্বাজ গোত্র, শাণ্ডিল্য গোত্র বলে সকলের পূজনীয়। (মাস্টারের প্রতি) শঙ্খচিলের কথাটি বল তো!”
[ রাঃকথামৃতঃ , চতুর্থ ভাগ, পৃষ্ঠা ১৯২ ; অখণ্ড সংস্করণ , পৃষ্ঠা ৫৫১, ৩য় প্রকাশ, ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ
অতঃ প্রমাণিত হয় যে উক্ত ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং সাম্প্রদায়িক মিথ্যাচার মাত্র । যারা এই প্রসঙ্গ তুলে শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীজীকে হেয় করার চেষ্টা করে তারাও উক্ত মিথ্যাচারী সম্প্রদায়ভুক্ত মাত্র ।
0 মন্তব্য(গুলি)