পূর্বপক্ষঃ ओ३म् বা ও৩ম্ হচ্ছে ॐ বা ওঁ এর বিকৃতরূপ।
উত্তরপক্ষঃ আমরা জানি বর্ণ দুই প্রকার, স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ। স্বরবর্ণ আবার দুপ্রকার, হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বর। বাংলা বা আধুনিক সংস্কৃতে বর্ণের এমনটাই বিভাজন। ফলে আমরা ও-বর্ণ দ্বারা ওম্ লিখনকে গ্রহণ করলেও, ও৩ম্ লেখা নিয়ে অনেকের নানাবিধ আপত্তি। অবশ্য এই আপত্তি কোনো বিদ্বদজনেরও নয়, আপত্তি আসছে একদল জাতপাতবাদীদের দলদাসদের পক্ষ থেকে। তারা লৌকিক সংস্কৃতকে বৈদিক সংস্কৃতের সাথে গুলিয়ে ফেলে অথবা বাংলা শব্দকোষ দিয়ে বৈদিক শব্দের অর্থ করে নানা সময়ে বিভিন্ন রকমের মূর্খতাসুলভ আপত্তি উত্থাপন করে। তারা অবগত নয় যে লৌকিক সংস্কৃত ও বৈদিক সংস্কৃত এক নয়। বৈদিক সংস্কৃতে হ্রস্বস্বর ও দীর্ঘস্বরের বাইরেও আরেক ধরনের স্বরবর্ণ উপস্থিত। তাকে বলা হয় প্লুতস্বর। বৈয়াকরণেরা বলেন-
“একমাত্রো ভবেদ্ হ্রস্বো দ্বিমাত্রো দীর্ঘ উচ্চতে।
ত্রিমাত্রস্তু প্লুতো জ্ঞেয়ো ব্যঞ্জনঞ্চার্দ্ধমাত্রকম্।।“
অর্থাৎ, হ্রস্বস্বর ১ মাত্রার হয়ে থাকে, ২ মাত্রাকে দীর্ঘস্বর বলা হয়। ৩ মাত্রাকে প্লুতস্বর ও ব্যঞ্জনকে অর্ধ মাত্রা বলে জানবে।
অর্থাৎ অ ১ মাত্রা, আ ২ মাত্রা ও ক্ ½ মাত্রা। এ নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু প্লুতের ৩ মাত্রা কীভাবে বোঝা যায়? হ্রস্বস্বর, দীর্ঘস্বর ও ব্যঞ্জনকে বোঝার জন্য মৌলিক প্রতীক বা বর্ণ থাকলেও, প্লুতস্বরের জন্য আলাদা প্রতীক বা বর্ণ নেই। তাই স্বরবর্ণের পর ‘৩’ লিখে প্লুতস্বর নির্দেশ করা হয়। প্লুত স্বর আটটি, যথা – অ৩, ই৩, উ৩, ঋ৩, এ৩, ঐ৩, ও৩, ঔ৩। পাণিনীয় শিক্ষার চতুর্থ শ্লোক বলছে “স্বরবর্ণ একুশটি”
পাণিনীয় শিক্ষার চতুর্থ শ্লোক
সেগুলো হচ্ছে লৌকিক সংস্কৃতের ১৩ টি বর্ণ ও ৮ টি প্লুত বর্ণ। অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বরবর্ণমালা হচ্ছে –
হ্রস্ব – অ, ই, উ, ঋ, ৯
দীর্ঘ – আ, ঈ, ঊ, ঋৃ, এ, ঐ, ও, ঔ
প্লুত – অ৩, ই৩, উ৩, ঋ৩, এ৩, ঐ৩, ও৩, ঔ৩
কেউ কেউ ৯ এরও প্লুতস্বর ধরে স্বরবর্ণ ২২টি গণনা করেন।
মহামুনি পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণের ৮।২।৮২ থেকে ৮।২।১০৮ – ২৭টি সূত্রে প্লুতস্বরের ব্যবহার উল্লেখ করেছেন। এখন নিন্দাকারীদের পঠনের অভ্যাস নেই বিধায় তা অবগত নয়। মূর্খ বলে শুদ্ধ ব্যবহারকে ভুল বলতেও কার্পণ্য বোধ করে না।
মন্ত্রের শুরুতে ওম্ ব্যবহার করা হলে তা হবে প্লুত উদাত্ত অর্থাৎ ও৩ম্ – এই বিধান রয়েছে অষ্টাধ্যায়ীর ৮।২।৮৭ সূত্রে। অন্যদিকে যজ্ঞকর্মের জন্য মন্ত্রের সর্বশেষ স্বরবর্ণ ও৩ম্ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, যা কিনা প্লুত উদাত্ত – এই বিধান পাওয়া যায় অষ্টাধ্যায়ীর ৮। ২।৮৯ সূত্রে। নিচে কাশিকাবৃত্তি সহ অষ্টাধ্যায়ী সূত্র দেখুন।
অষ্টাধ্যায়ী ৮।২।৮৭ সূত্র কাশিকাবৃত্তি সহ
অষ্টাধ্যায়ী ৮।২।৮৯ সূত্র কাশিকাবৃত্তি সহ
সেই মূর্খদের আর্য সমাজের প্রতি বিশেষ চুলকানি রয়েছে তাই আর্য সমাজের বাইরে, অন্যান্যদের কর্তৃক প্রকাশিত ও ভাষ্যকৃত বেদ থেকে দেখে নিই, বেদে ओ३म् বা ও৩ম্ আছে কি না।
১। পৌরাণিকদের প্রিয় সায়ণাচার্যের সামবেদ ভাষ্য যা ভববিভূতি ভট্টাচার্য কর্তৃক প্রকাশিত তা থেকে দেখতে পাই সামবেদের ৫৮৫ নং মন্ত্রে ओ३म् বা ও৩ম্ স্পষ্টভাবে উপস্থিত।
২। দুর্গাদাস লাহিড়ীর সামবেদ চতুর্থ খণ্ডের ৫৮৫ নং মন্ত্রে একদম বাংলা প্রতিলিপিতেই ও৩ম্ উপস্থিত।
৩। দামোদর সাত্বলেকরের সামবেদ সুবোধ ভাষ্যের ৫৮৫ নং মন্ত্রে ओ३म् বা ও৩ম্ উপস্থিত।
৪। চৌখম্বা থেকে প্রকাশিত শ্রী ভগবদাচার্যের সামবেদ ভাষ্যের একদম শুরুতে ओ३म् বা ও৩ম্ উপস্থিত। আর ৫৮৫ নং মন্ত্রে ও ভাষ্যের শেষে তো আছেই।
অর্থাৎ আর্য সমাজের নয়, এমন চারটি সামবেদ ভাষ্যেই দেখতে পাচ্ছি ओ३म् বা ও৩ম্ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এবার আর্য সমাজের নয় এমন বিদ্বানদের যজুর্বেদ থেকে একটু দেখে নিই সেখানে ओ३म् বা ও৩ম্ আছে কি নেই।
১। সর্বপ্রথম মহর্ষি মহেশ যোগী প্রতিষ্ঠিত “Maharishi University of Management” কর্তৃক প্রকাশিত যজুর্বেদ মূলপাঠ থেকে দেখে নিই। সেখানে দেখতে পাবো যজুর্বেদ এর ২য় অধ্যায়ের ১৩ নং মন্ত্র এবং ৪০শ অধ্যায়ের ১৫ ও ১৭ নং মন্ত্রে ओ३म् বা ও৩ম্ উপস্থিত। ২য় অধ্যায়ের ১৩ নং মন্ত্রে ओ३म् বা ও৩ম্ যে রয়েছে তা এর পদপাঠ থেকেই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন।
যজু ২।১৩ মূল ও পদপাঠ
যজু ২।১৩
যজু ৪০।১৫-১৭
২। পৌরাণিকদের প্রিয় উবট-মহিধর ভাষ্যের উপর্যুক্ত মন্ত্র তিনটিতে স্পষ্টভাবে ओ३म् বা ও৩ম্ বিদ্যমান। শুধু তাই না মহিধর তার যজুর্বেদ ভাষ্যের ৪০/১৭ মন্ত্রে স্পষ্টভাবে ओ३म् বা ও৩ম্ এর উল্লেখ করেছেন।
যজু ২।১৩ উবট-মহিধর ভাষ্য
যজু ৪০।১৫ উবট-মহিধর ভাষ্য
যজু ৪০।১৭ উবট-মহিধর ভাষ্য
৩। দামোদর সাত্বলেকরের যজুর্বেদ সুবোধ ভাষ্যে প্রথম মন্ত্রের শুরুতেই ओ३म् বা ও৩ম্ এর উল্লেখ করেছেন। আর উপর্যুক্ত তিনটি মন্ত্রে তো আছেই।
যজু ১।১
যজু ২।১৩
যজু ৪০।১৫
যজু ৪০।১৭
৪। গায়ত্রী পরিবারের রামশর্মার যজুর্বেদ ভাষ্যেও উপর্যুক্ত তিন মন্ত্রে ओ३म् বা ও৩ম্ উপস্থিত।
যজু ২।১৩
যজু ৪০।১৫-১৭
৫। ভগবতী শর্মা কর্তৃক প্রকাশিত যজুর্বেদ ভাষ্যের ২।১৩, ৪০।১৫ মন্ত্রে ओ३म् বা ও৩ম্ বিদ্যমান।
যজু ২।১৩
যজু ৪০।১৫
৬। যজুর্বেদ মিশ্রভাষ্যের ৪০।১৫ ও ৪০।১৭ মন্ত্রে ओ३म् বা ও৩ম্ স্পষ্টভাবে উপস্থিত।
যজু ৪০।১৫
যজু ৪০।১৭
৭। যজুর্বেদ কাণ্ব সংহিতা শুরুই হচ্ছে ओ३म् বা ও৩ম্ উল্লেখপূর্বক।
যজু ১।১
অর্থাৎ দেখতে পাচ্ছি আর্য সমাজের বাইরের সাতটি প্রখ্যাত ভাষ্য বা মূল পাঠেই ओ३म् বা ও৩ম্ বিদ্যমান।
সিদ্ধান্তঃ সামবেদ ও যজুর্বেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত ओ३म् বা ও৩ম্ থেকে আপনারা বুঝতে পারছেন ओ३म् বা ও৩ম্ কোনো বিকৃতরূপ নয়, বরং এটিই হচ্ছে বিশুদ্ধ বৈদিক ব্যবহার।
পূর্বপক্ষঃ শুধু ओ३म् বা ও৩ম্-এই কেন প্লুত ব্যবহার হয়? অন্য কোনো সংস্কৃত শব্দে তো দেখি না।
উত্তরপক্ষঃ কীভাবে দেখবেন? বৈদিক শাস্ত্রসমূহ যদি অধ্যয়ন করতেন, সংস্কৃত ব্যাকরণ যদি চোখে দেখতেন তবে না বুঝতে পারতেন প্লুত স্বরের ব্যবহার রয়েছে কি নেই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত ও কবিভূষণ হরলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত ব্যাকরণ কৌমুদীর প্রথম ভাগেই প্লুত স্বরের ব্যবহার বলা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে –
“বৈয়াকরণেরা অ ই উ ঋ এ ঐ ও ঔ এই আটটির দূরাহ্বান, গান ও রোদনজনিত সুদীর্ঘ উচ্চারণে প্লুতসংজ্ঞা নির্দ্দেশ করিয়া ইহাদিগকে প্লুতস্বর নামে স্বতন্ত্র স্বর বলিয়া গণ্য করেন।”
শুধু তাই নয়, কোথায় কোথায় প্লুতস্বর ব্যবহৃত হবে সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলেছেন মহামুনি পাণিনি অষ্টাধ্যায়ীর ৮।২।৮২ থেকে ৮।২।১০৮ এই ২৭টি সূত্রে।
অষ্টাধ্যায়ী ৮।২।৮২ থেকে ৮।২।১০৮
এখন আপনি বৈদিক গ্রন্থ পাঠ করবেন না, ব্যাকরণ পাঠ করবেন না, কিন্তু তারপর এসে মিথ্যা মায়াকান্না কাঁদবেন তা তো হতে পারে না। টিনের চশমা পরে দুনিয়া দেখতে গেলে যেমন হোঁচট খাবেন, তেমনি যথার্থরূপে অধ্যয়ন না করে কারো নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নিজে থেকেই মহাপাপের ভাগাড়ে নিমজ্জিত হবেন। এবিষয়ে কোনো সংশয় নেই।
বৈদিক শাস্ত্রসমূহে ओ३म् বা ও৩ম্ ব্যতীত কোথায় কোথায় প্লুত স্বর ব্যবহৃত হয়েছে তা সম্পূর্ণ উল্লেখ করতে গেলে এই লেখাটি শুধু দীর্ঘায়িত হবে, কিন্তু বৈদিক সম্প্রদায়ের প্রতি ঈর্ষান্বিত গোষ্ঠীর কতোটুকু জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন ঘটবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে। তথাপি কিছু উদাহরণ নিচে দিচ্ছি।
আপনারা অবগত আছেন ঋগবেদের দশটি মণ্ডল আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট মণ্ডল হচ্ছে ২য় মণ্ডল। সেই ২য় মণ্ডলেই অন্তত ১০টি মন্ত্রে প্লুতস্বর যুক্ত শব্দ দেখা যাচ্ছে। যথা-
ঋগবেদ ২।৪।২
ঋগবেদ ২।১০।৫
ঋগবেদ ২।১৬।২
ঋগবেদ ২।১৭।৭
ঋগবেদ ২।২৩।১৩
ঋগবেদ ২।২৪।১৫
ঋগবেদ ২।২৬।৪
ঋগবেদ ২।৩১।৬
ঋগবেদ ২।৩৯।২
ঋগবেদ ২।৩৯।৫
এক ২য় মণ্ডলেই এতো ব্যবহার, তাহলে গোটা চারবেদে আরো কতো থাকবে সেটা আন্দাজ করে নিন। এরপরও কি সন্দেহ থাকা উচিৎ যে ओ३म् বা ও৩ম্ ছাড়া অন্যত্র প্লুতস্বর ব্যবহৃত হয় কি না? অবশ্য চোখ বন্ধ করে রাখলে ঈর্ষান্বিত গোষ্ঠী কোথাও প্লুতস্বর দেখবে না সেটাই স্বাভাবিক।
সিদ্ধান্তঃ ओ३म् বা ও৩ম্ ছাড়াও বৈদিক শাস্ত্রসমূহে বহুস্থানে প্লুতস্বরযুক্ত শব্দ রয়েছে।
পূর্বপক্ষঃ সবই বুঝলাম। কিন্তু এভাবে উচ্চারণ ভেঙে ভেঙে দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। উচ্চারণ বিধি শেখানোর জন্য ছোটবেলায় শিক্ষকেরা সিলেবল ভেঙে ভেঙে দেখায়। এটা আসলে বৃহত্তর সনাতন সমাজ থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র সমাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই এমনটা করা হচ্ছে।
উত্তরপক্ষঃ এ দাবি সম্পূর্ণই ভ্রান্ত ও অজ্ঞতাপ্রসূত। ॐ বা ওঁ – কে ओ३म् বা ও৩ম্ রূপে লেখার অভিপ্রায় মোটেও এটা নয় যে এটা সিলেবল ভেঙে লেখা। যদি সিলেবল ভেঙে লেখা হতো তবে তা হতো এমন अ – उ – म् বা অ – উ – ম্। বরং আমরা বেদে উল্লেখিত রূপটাই ব্যবহার করছি যা ব্যাকরণ সম্মত। এখন ओ३म् বা ও৩ম্ – কে অনেকভাবেই লেখা যায়, বিভিন্ন ভাষাতে এর বিভিন্ন রূপ রয়েছে। এখন বিভিন্নরূপ ব্যবহার করতে সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু ব্যাকরণ সম্মত ও বেদে উল্লেখিত প্রয়োগ ব্যবহার করাতে কাদের সমস্যা হতে পারে তা আমাদের বুঝ-এ আসছে না। সম্মানিত পাঠকগণ নিজেরাই বুঝে নিবেন। আমরা ॐ, ওঁ, ओ३म्, ও৩ম্, ओम्, ওম্ ইত্যাদি প্রত্যেক ব্যবহারকেই মান্য করি।
সিদ্ধান্তঃ ओ३म् বা ও৩ম্ উচ্চারণের জন্য ভেঙে দেওয়া রূপ না। বরং বেদে উল্লেখিত ও ব্যাকরণ সম্মত প্রয়োগ মাত্র। ॐ, ওঁ, ओ३म्, ও৩ম্, ओम्, ওম্ ইত্যাদি প্রত্যেক ব্যবহারকেই মান্য করা উচিত; অযাচিত বিতণ্ডা তৈরি অনুচিত।
সত্যমেব জয়তে
ও৩ম্ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
0 মন্তব্য(গুলি)