https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

অতিথির জন্য ছাগ-বৃষ হত্যা ? সায়ণের ভুলের খণ্ডন

Wednesday, December 29, 2021




পৌরাণিকদের অতি প্রিয় সায়ণাচার্য বিশাল বৈদিক সাহিত্যের ভাষ্য করেছেন বলে কথিত । আধুনিক পরম্পরাবাদী ও পৌরাণিকগণ তার ভাষ্য অন্ধভাবে মানেন ও স্বীয় স্বার্থ পূর্তির জন্য যথেচ্ছ উদাহরণ প্রদান করেন । যদিও তার ভাষ্যের অর্থ ও তাৎপর্য বিকৃতি সযতনে আড়াল করে কেবল নিজেদের সাকারবাদ প্রমাণে আবশ্যকীয় অংশটুকুই উদ্ধৃত করেন । আজকে আমরা  ঐতরেয় ব্রাহ্মণে সায়ণের ভুল ভাষ্যে কথিত অতিথি এলে তার জন্য বৃহৎ ছাগ বা বৃষ রান্না কর‍্যে হবে - এই মতবাদটি খণ্ডন করবো । 

আলোচ্য কণ্ডিকা -


অগ্নি মন্থন্তি সোমে রাজন্যাগতে। তদ্ যথৈবাহঃ। মনুষ্যরাজ আগতেঽন্যস্মিন্ বার্হত্যুক্ষাণং বা বেহতং বা ক্ষদন্তে। এবমেবাস্মা এতত্ ক্ষদন্তে যদগ্নিং মন্থন্তি। অগ্নির্হি দেবানাং পশুঃ। 
(ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১।৩।৪)
অর্থাৎ 
সোমরাজ আগত হইলে অগ্নিমন্থন করিবে; তাহার এইরূপ। যেমন নররাজ অথবা অন্য পূজ্য ব্যক্তি উপস্থিত হইলে বৃষ অথবা বেহৎ ( গর্ভনাশিনী বৃদ্ধা গাভী ) হত্যা করে, সেইরূপ অগ্নির যে মন্থন হয়, তাহাতেই সোমের উদ্দেশে অগ্নির হত্যা করা হয় ; কেননা অগ্নিই দেবগণের পশু।



উল্লেখ্য বিধর্মী ও বলি মতবাদীরা যে অর্থ এখানে উল্লেখ করেছে তা রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার থেকে প্রকাশিত। তারা সেটিই উদ্ধৃত করে যা এই অনুবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার এর বিজ্ঞ অনুবাদকগণ কতটুকু বৈদিক সংস্কৃত সম্পর্কে অবহিত তাও সন্দেহজনক।
 
এই খণ্ডের যে অংশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তার মূলে রয়েছে,

অগ্নি মন্থন্তি সোমে রাজন্যাগতে। তদ্ যথৈবাহঃ। মনুষ্যরাজ আগতেঽন্যস্মিন্ বার্হত্যুক্ষাণং বা বেহতং বা ক্ষদন্তে। এবমেবাস্মা এতত্ ক্ষদন্তে যদগ্নিং মন্থন্তি। অগ্নির্হি দেবানাং পশুঃ। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ১।৩।৪)
অর্থাৎ 
রাজা সোমের আগমনে অগ্নি মন্থন অর্থাৎ যজ্ঞকুণ্ডে অগ্নি প্রজ্বলন করতে হবে। ঠিক যেভাবে, মানুষের গৃহে রাজা বা পূজনীয় ব্যক্তি আসলে বৃষ বা বেহত্ গাভী ক্ষদ্ করা হয়। সেইরূপ অগ্নির যে মন্থন বা অগ্নির যে প্রজ্বলন করা হয় তাই সোমের উদ্দেশ্যে অগ্নির ক্ষদ্ করা হয়। কেননা অগ্নিই দেবগণের পশু।

আমরা এখানে যে অর্থ করেছি সেখানে সংস্কৃতের মূল ক্ষদন্তে এর বাংলা করা হয়নি, তার ধাতুরূপেই তা রেখে দিয়েছি। এবার চলুন আমরা দেখি এখানে কোন অর্থ হওয়া উচিত এবং প্রাসঙ্গিক - 

এবার দেখুন এখানে সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ হচ্ছে অগ্নিমন্থন প্রক্রিয়া। আর এখানে অগ্নিমন্থনকে তুলনা করা হয়েছে আতিথ্যেষ্টি বা গৃহে অতিথি আগমনের সঙ্গে। এখন অগ্নি মন্থনে কি অগ্নিকে প্রজ্বলিত বা উৎপন্ন করা হয় না অগ্নিকে নিভিয়ে ফেলা হয়? অবশ্যই অগ্নিকে প্রজ্বলিত করা হয়, তার বিপরীতটা নয়। এখন যেসব বিজ্ঞ অনুবাদক এখানে ক্ষদন্তে এর অর্থ করেছে হত্যা করা তা কি অগ্নিমন্থনের সঙ্গে তুলনীয়? অগ্নিমন্থনে কখনোই অগ্নিকে হত্যা বা নিভিয়ে ফেলা হয় না। 

আমাদের মনে রাখতে হবে বেদ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ তথা বৈদিক সাহিত্যে যে শব্দগুলো এসেছে তা প্রাচীন সংস্কৃত বা বৈদিক সংস্কৃত। পরবর্তীকালের নবীন সংস্কৃতের সাথে তা তুলনা করলে অর্থ অনর্থ হয়ে যাবে। বৈদিক শব্দ ও ধাতুসমূহের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অন্যতম গ্রন্থ উণাদিকোষ। সেই উণাদিকোষের দ্বিতীয় পাদের পঁচানব্বইতম সূত্রে বলা হয়েছে, 
 
তৃন্তৃচৌ শংসিক্ষদাদিভ্যঃ সঞ্জ্ঞায়াং চানিটৌ। 
(উণাদিকোষ ২।৯৫[৯৪])
 
এখানে বিশ্লেষণে দেখা যায় 'ক্ষদ সংবৃতৌ' থেকে ক্ষদতি উৎপন্ন হয়। আর সেখান থেকেই আসে ক্ষদন্তে শব্দটি। 
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীও তাঁর উণাদিসূত্রভাষ্যে তা উল্লেখ করেছেন। 
 

 
এই সূত্র অনুযায়ী দেখা যায় ক্ষদন্তে শব্দের মূল ক্ষদ সংবৃত অর্থাৎ কোনকিছু প্রাপ্তি, শুরু, লাভ করা পৌঁছানো অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই উণাদিকোষ অনুযায়ী ক্ষদন্তে এর অর্থ হয় প্রাপ্ত হওয়া, শুরু করা, লাভ করা, পৌঁছানো বা কোনোকিছু পৌঁছে দেওয়া। বৈদিক কোষের কোথাও ক্ষদ ধাতু হিংসা বা হত্যা করা অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। তাই উণাদিকোষ অনুযায়ী ঐতরেয় ব্রাহ্মণের উপর্যুক্ত কণ্ডিকার অর্থ হবে
যেভাবে মানুষের গৃহে রাজা বা পূজনীয় ব্যক্তি আসলে তাদের উদ্দেশ্যে বৃষ বা বেহত্ গাভী পৌঁছে দেওয়া হয় বা তাদেরকে প্রাপ্ত করানো হয়। সেইরূপ অগ্নির যে মন্থন বা অগ্নির যে প্রজ্বলন করা হয় তাই সোমের উদ্দেশ্যে অগ্নির প্রাপ্ত করানো।

অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন অগ্নিমন্থনে যেমন সোমের উদ্দেশ্যে অগ্নিকে প্রাপ্ত করানো হয় অর্থাৎ প্রজ্বলিত করা হয়, ঠিক তেমনি অতিথি আসলে বৃষ বা গাভী প্রাপ্ত করানো হয় বা দান করা হয়। যারা আমাদের দ্বিতীয় পর্বের ভিডিও দেখেছেন তারা কি এর সঙ্গে কোনো মিল পাচ্ছেন? যদি সে ভিডিও দেখে থাকেন তবে মিল পাওয়ারই কথা।

ভিডিওটি দেখে নিন - https://youtu.be/sL83YiIl8S4

 সেখানে আমরা দেখিয়েছিলাম গৃহে অতিথি আসলে অতিথিকে মধুপর্ক প্রদান করে গোদান করা হতো। গোহত্যা করা হতো না। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের এই খণ্ডে সেই অনুষ্ঠানেরই উল্লেখ করা হয়েছে। যদি আপনারা সেই ভিডিও দেখে না থাকেন তবে অনুগ্রহ করে দেখে নিন।

অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন অতিথি আসলে গোদানের রীতি ছিল, হত্যা করার না। কিন্তু আমাদের তথাকথিত পরম্পরা দাবিকারীদের পূর্বজ সায়ণাচার্য ও ষড্গুরুশিষ্যের দ্বারা ক্ষদন্তে শব্দটি ভুলভাবে ব্যাখ্যা হওয়ার জন্যই এই সন্দেহের অবকাশ তৈরি হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি উণাদিকোষে ক্ষদ ধাতু হত্যা করা বা হিংসা অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু সায়ণাচার্য ও ষড্গুরুশিষ্য উভয়েই তাদের ব্যাখ্যায় ক্ষদন্তি হিংসন্তি ও ক্ষদিহিংসার্থঃ ব্যাখ্যা করেছে।
 
 


সায়ণাচার্য - ক্ষদন্তে হিংসন্তি





ষড্গুরুশিষ্য- ক্ষদন্তে ক্ষদিহিংসার্থঃ

 
 
উণাদিকোষের প্রমাণ থেকেই বুঝতে পারছি এই দুজনের ব্যাখ্যাই অমূলক ও ভ্রান্ত। যারা দাবি করেন সায়ণাচার্য কোনো ভুল ব্যাখ্যা করেন না বা সায়ণাচার্যের সমস্ত ব্যাখ্যাই শুদ্ধ তাদের এখানে নিশ্চয়ই কিছু বলার নেই। অপরদিকে আমরা যেমন সায়ণাচার্যের যেস্থলে ভুল ব্যাখ্যা রয়েছে তার গঠনমূলক সমালোচনা করি ঠিক সেভাবে যেস্থলে সায়ণাচার্যের ব্যাখ্যা শুদ্ধ তা আমরা গ্রহণ। অন্যদিকে রিডিং স্বর্বস্ব সাকারবাদীরা না তো বৈদিক শব্দের অর্থ ঠিকভাবে জানে না তো সে যোগ্যতা তার রয়েছে। তাই তারা কপিপেস্ট ও রিডিং নির্ভর প্রলাপই বকে থাকেন।

এমনকি ক্ষদ ধাতুর এমন প্রাপ্ত করানো বা দানকর্ম যে সায়ণাচার্য যে অবগত ছিলেন না এমনটিও নয়। সায়ণাচার্য তাঁর ঋগবেদ ষষ্ঠ মণ্ডলের ত্রয়োদশ সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রের ক্ষত্তা শব্দটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন ক্ষদতিরত্র দানকর্মা অর্থাৎ এখানে ক্ষদতি শব্দটি দানকর্ম হিসেবে এসেছে।  
 
 

 
তবে আপনারাই দেখুন সায়ণাচার্য সঠিক অর্থ অবগত হয়েও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ভুল অর্থ করায় এই উদ্ভট অনভিপ্রেত ঝামেলার উদ্রেক হয়েছে। উল্লেখ্য লৌকিক সংস্কৃতে পরবর্তীতে ক্ষদ ধাতুর অর্থ আরো ব্যাপকভাবে প্রচলিত হলেও আমাদের মনে রাখতে হবে বৈদিক সাহিত্যে লৌকিক সংস্কৃতের অর্থ প্রয়োগ হবে না। যা আমাদের দ্বিতীয় পর্বে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

শুধু তাই নয় ঐতরেয় ব্রাহ্মণের এই অগ্নিমন্থন ক্রিয়া ঋগবেদের অপর ব্রাহ্মণ কৌষীতকি ব্রাহ্মণের অষ্টম অধ্যায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লেখিত হয়েছে, সেখানে কোনও পশুহত্যার প্রসঙ্গই আসেনি। বরং কৌষীতকি ব্রাহ্মণের একাদশ অধ্যায়ের তৃতীয় খণ্ডে উল্লেখ করা হয়েছে -
 
তদ্ যথা হ বা অস্মিঁলোকে মনুষ্যাঃ পশুনশ্নতি। যথৈভির্ভুঞ্জতে। এবমেবামুষ্মিঁল্লোকে পশবো মনুষ্যানশ্নন্তি। এবমেভির্ভুঞ্জতে। (কৌষীতকি ব্রাহ্মণ ১১।৩)
অর্থাৎ 
যেমন এই লোকে বা জীবনে যেসকল মানুষ পশুকে হত্যা করে খেয়ে থাকে, তা খেয়ে আনন্দলাভ করে; ঠিক তেমনি সেসকল পশু পরবর্তী লোকে বা জীবনে সেই মানুষদের ভক্ষণ করবে, তা ভক্ষণ করে আনন্দলাভ করবে। 


তাই বুঝতেই পারছেন গৃহে আগত অতিথির জন্য বৃষ বা গাভী হত্যা তো দূরে থাকুক, পশুকে হত্যা করে তা ভক্ষণ করা এই ব্রাহ্মণ বচনে নিন্দা করা হচ্ছে। তাছাড়া দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখিয়েছি বেদে শুধু গাভীই নয়, বৃষ হত্যাও নিষিদ্ধ। যারা সে ভিডিও দেখতে পারেননি তা পুনরায় দেখে নিন। অর্থাৎ সম্পূর্ণ আলোচনা থেকে বোঝা যায় ঐতরেয় ব্রাহ্মণের ওই খণ্ডে বৃষ বা গাভী হত্যা নয় বরং তা দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।