https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

বেদ মন্ত্রের বিনিয়োগ

Friday, May 6, 2022

 

সৃষ্টির আদিতে‌ পরমপিতা পরমাত্মা‌ সমগ্র‌ জীবের‌ কল্যাণার্থে‌ বেদ‌ জ্ঞান‌ ঋষিদের‌ দ্বারা‌ প্রদান‌ করেছেন‌ ; যার‌ স্বরবর্ণানুপূর্বী নিত্য‌, এমনটা ঋষি-মুনিগণের‌ সিদ্ধান্ত । মন্ত্রার্থ দ্রষ্টার নাম ঋষি। মন্ত্রের প্রতিপাদিত্য‌ বিষয়‌ দেবতা‌ । মন্ত্রের‌ অক্ষর‌ গায়ত্রী-অনুষ্টুপ্‌ আদি ছন্দে নির্মিত এবং যে‌ যে‌ মন্ত্রের‌ উচ্চারণ পূর্বক‌ শ্রৌত‌ বা‌ গৃহ্য‌ কর্মসমূহের‌ ক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে সেই মন্ত্র‌ সেই-সেই ক্রিয়াতে‌ বিনিয়ুক্ত‌ হয়, বা‌ উক্ত মন্ত্রের‌ সেই-সেই ক্রিয়ায়‌ বিনিয়োগ‌ রয়েছে । এটা শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত ।
এ দ্বারা এই বিষয় স্পষ্ট‌ যে‌, ঋষি-দেবতা‌-ছন্দ‌ এবং বিনিয়োগের প্রাদুর্ভাব পরবর্তীকালে হয়েছে । দ্বিতীয়ত, এই প্রকরণ‌ ঋষিকৃত‌ বা পুরুষকৃত‌, ঈশ্বরকৃত‌ বা অপৌরেষয়‌ নয় । ছন্দসমূহের‌ নামকরণ‌ বেদে উপলব্ধ‌ পরন্তু গণনা‌ ঋষিকৃত‌ । এর‌ মধ্যে বেদের‌ অর্থের‌ সাথে সরাসরি ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেবতাই, কেননা " য়া‌ তেনোচ্যতে সা‌ দেবতা‌ " ( সর্বানুক্রমণিকা‌ ) যে‌ মন্ত্র‌ দ্বারা‌ উল্লেখ করা হয়ে থাকে, তার‌ নাম দেবতা‌ ; অর্থাৎ, মন্ত্র‌ যাকে‌ প্রতিপাদন‌ করে‌ তা‌ দেবতা । সুতরাং অর্থের সহিত‌ দেবতার সাক্ষাৎ সম্বন্ধ রয়েছে । কোন মন্ত্রের‌ দ্রষ্টা কে‌, এ দ্বারা‌ ইতিহাস সম্বন্ধী পর্যাপ্ত জ্ঞান‌ পাওয়া সম্ভব, সেই ইতিহাসে‌ মন্ত্রসম্বন্ধী‌ যদি কোনো গম্ভীর‌ অর্থের‌ নিরুপণ‌ হয়, তো সেটাও‌ কিছু না কিছু অর্থ‌ অনুধাবনে সহায়ক‌ হয়ে যাবে । কিন্তু এমন ইতিহাস ব্রাহ্মণ শাস্ত্রগুলোতে‌ই নামমাত্র‌‌ বুঝতে হবে । এই অবস্থায় মন্ত্রসমূহের‌ ঋষি‌ তাঁর প্রদত্ত অর্থকে বোধগম্যে‌ বা‌ অনুধাবনে সহায়ক নয় । ঋষি মন্ত্রার্থদ্রষ্টা‌ হোক‌ বা‌ ঋষিকে‌ কবিনিবদ্ধক্তা‌ মানা হোক‌, তবু‌ও অর্থ‌ অনুধাবনে ভেদ‌ হয় না, কিছু নির্দেশ পাওয়া যায় । এরূপ অবস্থায় দেবতা প্রকরণ‌ বিদ্যমানে ঋষির‌ আবশ্যকতা‌ কতটুকু রয়েছে, এটাও‌ একটি পৃথক বিচারণীয়‌ বিষয়‌ । ছন্দের‌ উপযোগ‌ প্রচুর বিদ্যমান । শ্রৌতপ্রক্রিয়ায়‌ এর বৃহৎ‌ মহত্ত্ব‌ রয়েছে, কিন্তু বেদার্থে এ‌ই প্রকরণে‌র‌ও সরাসরি কোনো সম্বন্ধ নেই ।
র‌ইলো বিনিয়োগ‌ । যা‌ বিস্তারিত বিশ্লেষণ‌ করা হবে ।

  • বিনিয়োগ‌ শব্দের‌ অর্থ‌

" বি‌ " " নি " দুই উপসর্গপূর্বক " য়ুজির্‌ য়োগ‌ " ( রুধা ) এই ধাতু‌ দ্বারা‌ কর্ম‌ এবং ভাবে‌ " বিনিয়ুজ্যত‌ ইতি‌ বিনিয়োগ‌ঃ " বিনিয়োজন‌ বা‌ বিনিয়োগঃ " , য়দ্বা " বিনিয়ুজ্যতেऽনেনেতি‌ বিনিয়োগঃ " করণ কারকে ঘ‌ঞ্‌ প্রত্যয়ে এই শব্দ গঠিত হয় । এখানে ভাব‌ এবং করণ‌ অর্থ‌ অধিক‌ উপযুক্ত‌ । বি‌ ( বিশেষতয়া‌ ) নি‌ ( নিশ্চয় দ্বারা‌ ) যোজনং‌ ( যু্ক্ত‌ করা‌ ) = বিনিয়োগ‌ বলা হয় । কোনো‌ ক্রিয়া সম্পন্ন করার‌ সময় সেই ক্রিয়ার‌ প্রারম্ভে‌ যে‌ মন্ত্র‌ উচ্চারণ‌ করতে হয়‌, যেমন‌: " শন্নো দেবী " ইত্যাদি‌ মন্ত্র‌ উচ্চারণ‌ পূর্বক‌ আচমন ক্রিয়া সম্পন্ন করা‌ হয়, এই " শন্নো‌ দেবী‌ " উক্ত মন্ত্রের‌ আচমণের‌ বিনিয়োগ‌ ; এমনটা বলা হয় ।
যদি‌ বলা‌ হয় যে‌, এই মন্ত্রের প্রয়োগ আচমনে হয়ে থাকে‌ অথবা‌ এই মন্ত্র আচমন ক্রিয়ায়‌ প্রযুক্ত‌ বা বিনিযুক্ত‌ ( Applied ), তো বিষয়টা‌ এক‌ই বুঝায় । Application of a Mantra " কোনো মন্ত্রকে কোনো ক্রিয়ায়‌ প্রয়োগ‌ করা‌ " বিনিয়োগের সংজ্ঞা এটাই ।
সুতরাং যদি‌ কোনো মন্ত্রের‌ যে‌ অর্থ‌, তার‌ সাপেক্ষে প্রয়োগমূলক‌ ক্রিয়ার‌ সহিত কোনো বিঘ্ন‌ না ঘটে‌ যথার্থ‌ প্রয়োগ‌ হয় তাহলে‌ সেই বিনিয়োগ‌ সঠিক‌ ।
 
যদি‌ কোনো ব্যক্তি‌ " শন্নো‌ দেবী‌ " এই মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক‌ ব্যায়াম‌ করতে থাকে‌, তখন‌ তা‌ সেই মন্ত্রের‌ প্রয়োগ প্রকরণ‌ বিরুদ্ধ, সেই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ ভুল‌ ।
 
বিনিয়োগের প্রাদুর্ভাব কখন ?
– যে‌ সময় থেকে যজ্ঞ চলমান‌ ।
– যজ্ঞের প্রাদুর্ভাব কখন ?
 
এটা অত্যন্ত গম্ভীর‌ বিচারের বিষয় । প্রথমে যজ্ঞ শব্দের‌ উপর‌ বিচার আবশ্যক‌ । যদি‌ অগ্নিতে‌ আহুতি‌ প্রদানের নাম‌ই যজ্ঞ হয়‌, তাহলে‌ তো‌ আর‌ও কয়েকভাবে বিচার‌ করতে হবে যে‌, দেবযজ্ঞ‌ এর প্রাদুর্ভাব কখন‌, সৃষ্টির আদিতে‌ কি পঞ্চ মহাযজ্ঞের‌ প্রবৃত্তি‌ ছিলো নাকি ছিলো না । বেদে কি এই বিষয়ে‌ কিছু নেই ‌। বিকাশবাদীদের‌ মতানুসারে‌ যখন‌ আবশ্যকতা‌ হয়েছিলো‌, তখন‌ পঞ্চ‌ মহাযজ্ঞ‌ আদির‌ প্রচলন‌ হয় ।
এমনটা‌ সর্বথা‌ বেদ বিরুদ্ধ । কেননা, ব্রহ্মযজ্ঞ‌ ঈশ্বরোপসনা‌ মানবসৃষ্টির‌ প্রারম্ভ‌ থেকে‌ই চলমান ।" অগ্নিমীডে‌ পুরোহিতম‌ " " ইষে‌ ত্বোর্জ্জে‌ ত্বা " এসব জ্ঞান‌‌ তো প্রারম্ভে‌ই প্রদান‌ করা হয়েছে । জগত নিয়ন্তা‌র উপাসনা তো সর্বপ্রথম মনুষ্যকেই‌ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । এতটুকু‌ই নয় ।
 
" অগ্নিমীডে পুরোহিতং য়জ্ঞস্য‌ দেবমৃত্বিজম্‌ । হোতারং‌ রত্নধাতমম্‌ ।।
 
ঋগ্বেদের এই সর্বপ্রথম মন্ত্রেই প্রকাশস্বরূপ অগ্নি‌ পরমেশ্বরের‌ উপাসনা করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে, এখানে‌ ভৌতিক অগ্নিকেও‌ নির্দেশ করা হয়েছে । তাঁকে যজ্ঞের দেব‌ পুরোহিত‌, ঋত্বিক্‌ এবং হোতাও‌ বলা হয়েছে । যজ্ঞের‌ স্বরূপ‌ সম্বন্ধে তো প্রারম্ভে‌‌ই বলা হয়েছে ।
 
য়জ্ঞেন য়জ্ঞময়জন্ত দেবাস্তানি ধর্মাণি প্রথমান্যাসন্।
তে হ নাকম্ মহিমানঃ সচন্ত য়ত্র পুূর্ব সাধ্যাঃ সন্তি দেবাঃ।। ( যজু‌: ৩১/ ১৬ )
য়স্মাদ্দতে ন সিধ্যতি য়জ্ঞো বিপশ্চিতশ্চন।
স ধীনাম য়োগমিন্বতি ।। ( ঋগ্বেদ: ১/১৮/৭ )
 
যজ্ঞের‌ প্রারম্ভ‌ পরবর্তীকালে‌ হয়েছে, এটা সম্পূর্ণ বেদ বিরুদ্ধ এবং সর্বথা‌ অমান্য‌ । যজ্ঞের‌ প্রাদুর্ভাব সৃষ্টির‌ আদিতেই‌ হয়েছে । এটাই সমগ্র বৈদিক সাহিত্যে উপলব্ধ এবং প্রামাণ্য, সত্য । অন্যভাবে‌ও বলা যায়‌ যে‌, বর্তমানে‌ প্রচলিত‌ যজ্ঞের‌ পরম্পরা‌, যা‌ পূর্ণ‌ বৈদিক হ‌ওয়ার‌ পক্ষে‌ দৃঢ়‌ ভ্রান্তপূর্ণ‌, মহাভারত যুদ্ধের‌ পর পর‌ প্রচলিত হয়েছে । হোক‌ সে‌ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে‌ উল্লেখিত নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া‌ বা‌ শ্রৌত-গৃহ্যাদি‌র প্রক্রিয়া । যখন‌ কেবল‌ অগ্নিতে‌ আহুতি‌ দেওয়াকেই যজ্ঞের স্বরূপ বোঝা হয়েছে, তখন‌ এই রূঢ়ি-যজ্ঞ‌ নিশ্চয়‌ই পরবর্তী কালের‌ প্রচলন‌ এবং রচনা‌ ।
 
এমন স্থিতিতে‌ মানা‌ আবশ্যক‌ যে‌, সৃষ্টির‌ আদিতে‌ বেদমন্ত্র‌ দ্বারা‌ অন্তর্যামী প্রভুর চিন্তন-আরাধনা-উপাসনা-ভক্তি‌ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক‌ চিন্তন‌ অবশ্য‌ই বিদ্যমান ছিলো, যা‌কে ব্রহ্মযজ্ঞ বলে । মূল‌ বিষয়‌ এটা যে‌, যে‌ যে‌ ঋষি‌ যে‌ যে‌ মন্ত্রের‌ অর্থদর্শন করেছেন‌, অর্থাৎ সেই সেই মন্ত্রের দ্রষ্টা যে‌ অর্থ‌ দর্শন‌ করেছেন, এর আধারে‌ ঐ ঐ‌ মন্ত্রের‌ প্রয়োগ‌ বা বিনিয়োগ‌‌ও তাঁর জ্ঞাত এবং অপরকে বর্ণনা করতেন‌ । নিশ্চয়‌ই মহাভারত কাল‌ পর্যন্ত‌ও এরূপভাবে বেদ‌ মন্ত্র‌ দ্বারা‌ কার্য‌সম্পন্ন হতো । এতে‌ কোনোরূপ সন্দেহ‌ নাই । সেই কার্যগুলোই সেসব মন্ত্রের বিনিয়োগ‌ ছিলো‌ । এটাই মানা সমুচিত ।
 
এই প্রকারে ব্রাহ্মণগ্রন্থ, শ্রৌত‌ তথা‌ গৃহ্যসূত্র‌ গুলোতে‌ নির্দিষ্ট বিনিয়োগ‌ নিশ্চিতরূপেই পরবর্তীকালের, এতে‌ সন্দেহ নাই ।
তৃতীয় প্রকারের‌ একটি বিনিয়োগ‌ বিদ্যমান, যা‌ উক্ত‌ ব্রাহ্মণ‌, শ্রৌত আদি‌ থেকে ভিন্ন । এর প্রচলন গৃহ্যকালের বিনিয়োগ দ্বারা‌ই স্বল্প প্রারম্ভে হয় এবং এক‌ই সাথে এর প্রয়োগ বর্তমান কাল‌ ( পূর্ববর্তী শত বর্ষের‌ পূর্বে‌ ) পর্যন্ত‌ বেড়েই চলেছে । বিনিয়োগের প্রচলন‌ কোন সময় থেকে বিদ্যমান, তা কয়েকভাবে ভাগ করা যায়‌ । প্রথম সময়কাল সৃষ্টির আদি‌ থেকে ব্রাহ্মণ-শ্রৌত‌ আদি‌ গ্রন্থ পর্যন্ত বলা যায় । দ্বিতীয় সময়কাল ব্রাহ্মণ গ্রন্থ‌ থেকে শুরু করে‌ এক-দুই শতাব্দী পূর্ব পর্যন্ত । তৃতীয় সময়কাল‌ এক-দুই শতাব্দী থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত । যজ্ঞের‌ও এই তিন‌ ভিন্ন-ভিন্ন কাল‌ বিদ্যমান‌ ।
  • বিনিয়োগের বাস্তবিক স্বরূপ

যদ্যপি‌ বিনিয়োগ‌ শব্দের অর্থ‌ প্রদর্শনের সাথে উপরোক্ত প্রকরণে‌ সংক্ষেপে‌ বিনিয়োগের স্বরূপ সম্বন্ধে‌ বর্ণনে উল্লেখ করা হয়েছে যে‌, কোনো মন্ত্রকে‌ কোনো ক্রিয়ায়‌ বিনিযুক্ত‌ ( Applied ) করাই সেই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ‌ বলা হয় । অথবা‌ কোনো মন্ত্র‌কে কোনো ক্রিয়ায় প্রয়োগ করাকে‌ ( Application of Mantra ) বিনিয়োগ‌ বলা হয় । বিনিয়োগের‌ স্বরূপ এটাই । একে আর‌ও বিস্তার‌পূর্বক ব্যক্ত‌ যদি‌ করা‌ হয় তো‌ এমনটা‌ বুঝতে হবে যে‌, যদি‌ একটি মন্ত্রের অর্থ‌ উক্ত‌ ক্রিয়ার‌ সাথে‌ ঠিক-ঠিক‌ প্রয়োগ হয়‌ বা সামঞ্জস্য হয়, অর্থাৎ যখন‌ এই দুই প্রকরণের ( মন্ত্র‌ এবং ক্রিয়া ) সমন্বয়‌ হয়ে যায়, দুটি‌ এক‌ই বিষয়‌ প্রকাশ‌ করছে‌, তখন‌ সেই বিনিয়োগ‌ সত্য‌, বেদানূকূল‌, বাস্তব‌, যুক্তিসম্মত‌, গ্রাহ্য‌ । যদি‌ মন্ত্র‌ একটি অর্থ‌ নির্দেশ করছে‌ কিন্তু ক্রিয়া‌ ভিন্ন‌ অর্থ‌ প্রকাশ করছে‌ তখন‌ সেই মন্ত্রের‌ সাপেক্ষে সেই বিনিয়োগ‌ অসত্য, কৃত্রিম‌, প্রকরণ‌ বহির্ভূত, বেদ বিরুদ্ধ, অগ্রাহ্য‌, অমান্য‌ হবে ‌।
এটাই মৌলিক এবং মূল‌ সিদ্ধান্ত‌, যার‌ পক্ষে‌ প্রচুর আর্ষ‌ প্রমাণ‌ বিদ্যমান —-
 
১. " এতদ্‌ বৈ‌ য়জ্ঞস্য‌ সমৃদ্ধং‌ য়দ্‌ রূপসমৃদ্ধম্‌ । য়তকর্ম‌ ক্রিয়মাণমৃগ্যজুর্বাऽভিবদতীতি‌ চ‌ ব্রাহ্মণম্‌ । " ( নিরুক্ত. ১/১৬ )
২.অত্র‌ দুর্গাচার্য‌ঃ ( পৃষ্ঠা. ৭৪ ) — " ব্রাহ্মণমপি‌ চ‌ মন্ত্রাণামর্থ‌বত্ত্বমেব‌ দর্শয়তি‌ । অনর্থকা‌ হি সন্তঃ কথং কর্মাভিবদেয়ুঃ, কথং‌ বাऽনভি‌বদন্তঃ সমর্দ্ভয়েয়ুঃ ।
২. " এতদ্‌ বৈ‌ য়জ্ঞস্য‌ য়জুর্বাऽভিবদতি‌ । "
( গোপথ‌ ব্রাহ্মণ‌. ২/২/৬ )
৩.
ক. " এতদ‌্‌ বৈ‌ য়জ্ঞস্য‌ সমৃদ্ধং‌ য়দ্‌ রূপসমৃদ্ধম্‌ " য়ৎকর্ম‌ ক্রিয়মাণমৃগ্যজুর্বাভিবদতি‌ ।। " ( ঐতরেয়‌ ব্রাহ্মণ. ১/৪/৯ )
খ. ষড়গুরুশিষ্যবৃত্তিঃ ( পৃষ্ঠা‌. ৩১ ) " এষা‌ সমৃদ্ধির্য়জ্ঞস্য‌ যদ্দক্‌কর্ম‌ প্রকাশয়েৎ‌ । "
এইসব স্থলে‌ এক‌ই‌ অর্থ‌ প্রদর্শন করছে‌ যে‌, যজ্ঞের‌ সমৃদ্ধি‌ ( সম্পূর্ণতা‌ ) তখন‌ই‌ পায়‌ যখন‌ সেই কর্মের‌ ঋচা‌ বা‌ যজুঃ ঠিক-ঠিক‌ ভাবে প্রয়োগ‌ হয় । যদি‌ মন্ত্র‌ সেই অর্থের‌ প্রতিপাদন‌ না করে‌ তাহলে‌ যজ্ঞের‌ সম্পূর্ণতা‌ অসম্ভব । এটাই বিনিয়োগের‌ বাস্তবিক‌ স্বরূপ । মন্ত্রের অর্থ‌ এবং তা দ্বারা‌ প্রয়োগকৃত‌ ক্রিয়া‌ একসূত্রে‌ অবশ্য‌ই থাকতে‌ হবে ।
  • বিনিয়োগ‌ এবং প্রাচীন তথা‌ মধ্যকালীন‌ গ্রন্থ

বিনিয়োগ‌ শব্দ‌ বেদ‌ এবং ব্রাহ্মণগ্রন্থে‌ উল্লেখ নাই । সংহিতা‌ গ্রন্থেও‌ অনুপলব্ধ‌ । নিম্নাঙ্কিত‌ মন্ত্রসমূহে‌ এই প্রকারে‌ বিদ্যমান —-
 
১. বৃহদ্দেবতা‌ —
ক. বিনিয়োগঞ্চ‌ কর্মণাম্‌ । ৭/১১৩ ।।
খ. শক্তিপ্রকাশনেনৈষাং‌ বিনিয়োগऽত্র‌ কীর্ত্যতে‌ । ৮/১০ ।।
অর্থাৎ, অর্থের‌ সামর্থ্য‌ হ‌ওয়ার‌ দরূণ‌ এই মন্ত্রের‌ এই বিষয়ে‌ বিনিয়োগ‌ হয় ।
 
২. নিরুক্ত‌ —
ক. ইত্যৃত্বিক্কর্মণাং‌ বিনিয়োগমাচষ্টে‌ । নিরুক্ত‌. ১/৮
এই বিষয়ে‌ নিরুক্ত‌ ৭/২০ তথা‌ ১২/৪০ নং শ্লোক‌‌ও দ্রষ্টব্য‌
খ. অত্রাচার্য়ঃ স্কন্দস্বামী — " বিনিয়োগঃ প্রতিনিয়মঃ । এক‌ ঋত্বিগিদং‌ কর্ম‌ করোত্যন্য‌ ইদমন্য‌ ইদমিতি‌ ঋচাং‌ পোষমিতি‌ য়থাবিধি‌ কর্মণি‌ প্রয়োগঃ…….. ( স্কন্দ‌কৃত‌ নিরুক্ত‌ টীকা‌. ভাগ ১ )
গ. ঋত্বিক্কর্মণাং‌ বিনিয়োগমনর্চাऽऽচষ্টে‌ ।
( দুর্গকৃত‌ নিরুক্ত‌ টীকা‌ )
নিরুক্তের‌ এই প্রকরণের‌ অর্থ‌ কেবল‌ এতটুকুই যে‌‌, ঋচাং‌ ত্বঃ পোষমাস্তে‌…… ঋগ্বেদ. ৭/৭১/১১ এই মন্ত্র ঋত্বিজগণের‌ কর্মের‌ নিযুক্তি‌ বা‌ প্রতিনিয়ম‌ ( নিয়তি‌ ) বর্ণনা‌ করেছে । স্কন্দ‌ এবং দুর্গ‌'র‌ও অভিপ্রায় এটা । মহর্ষি যাস্কের‌ বচনানুসারে‌ সিদ্ধ হয় যে‌,‌ বেদ‌ তাঁর স্ব‌অর্থ‌ দ্বারা‌ বিনায়োগের‌ সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন‌ করে ।
 
৩. যজুঃসর্বানুক্রমণী‌ –
ক. ইষেত্বা‌ শাখাऽনুষ্টুপ্‌ । বিনিয়োগ‌ঃ কল্পকারোক্তঃ । পৃষ্ঠা‌. ১৩ ( কাশী সংস্করণ‌ )
খ. কাম্যনৈ‌মিত্তিকাদিষু‌ বিনিয়োগোऽস্য‌ ( পৃষ্ঠা‌. ৩০৯ ) অগ্নৌ‌ বিনিয়োগঃ ( পৃষ্ঠা. ৩০৭ )
গ. দেবতা‌ মন্ত্রবর্ণাদ্দগ্যজুষো‌ বিনিয়োগতশ্চ‌ বিজ্ঞেয়াঃ । ( পৃষ্ঠা‌. ৩১৯. )
ঘ. বেদিতব্য‌ ইতি‌ শেষঃ । অস্য‌ মন্ত্রস্য‌ । তস্মিন্‌ কর্মণি‌ বিনিয়োগঃ । অনেন‌ মন্ত্রেণেদং‌ কর্ম‌ কর্তব্যম্‌, অনেনেদমিত্যেবং‌ বিধৌ‌ মন্ত্রাণাং‌ বিনিয়োগঃ‌ কল্পকারোক্তং‌ এবেহ‌ বেদিতব্যং‌ । কর্মানুষ্ঠানবেলায়াং‌ মন্ত্রাণাং‌ বিনিয়োগজ্ঞানমাবশ্যকম্‌ । তদজ্ঞানে‌ দোষস্য‌ প্রাগুক্তত্বাৎ‌ । ………তত ইষে‌ ত্বেত্যস্য‌ শাখাছেদনে‌ বিনিয়োগঃ‌ ।
( যজুঃ সর্বানুক্রমণী‌. পৃষ্ঠা ১৪)
এখানে‌ "" ইষে ত্বা "" এই মন্ত্রের‌ শাখাছেদনে বিনিয়োগের‌ নিয়মাবলী বর্ণিত হয়েছে ।
 
৪. ঋক‌সর্বানুক্রমণী‌ টীকা‌, ষড়গুরুশিষ্য, পৃষ্ঠা. ৫৭, ৫৮
স্মর্য়তে‌ –
অবিদিত্বা‌ ঋষিচ্ছন্দো‌ দৈবতং‌ য়োগমেব‌ চ‌ ।
য়োऽধ্যাপয়েদ্যজেদ্‌ বা‌ऽপি পাপীয়ান্‌ জায়তে‌ তু‌ সঃ ।। ….
অন্যত্রাপ্যুক্তম্‌ —
স্বরো‌ বর্ণোऽক্ষরং‌ মাত্রা‌ বিনিয়োগऽর্থ‌ এব‌ চ‌ । মন্ত্রং‌ জিজ্ঞাসমানেন‌ বেদিতব্যং‌ পদে‌ পদে‌ ।।
উপরোক্ত শ্লোকগুলোতে‌ বর্ণিত‌ হয়েছে‌, যে মন্ত্রের‌ যোগ‌ বিনিয়োগ‌ সম্বন্ধে‌ না জেনে‌ অধ্যয়ন‌ করায়‌ বা‌ যজ্ঞ‌ করায়‌, সে‌ পাপী‌ হিসেবে পরিগণিত হয় ইত্যাদি‌ ।
ক. পৃষ্ঠা‌. ১০৩, ১১৬, ১৩২ -এ‌ টীকাকার‌ বিনিয়োগ‌ শব্দ‌ দ্বারা‌ সূক্ত‌ ব‌ মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ‌ দর্শিয়েছেন ।
 
৫. আচার্য স্কন্দ স্বামী‌ ঋগ্বেদ‌. ১/১/১ নং মন্ত্রের‌ ভাষ্যে‌ বর্ণনা করেন –
তেষাং‌ য়োऽর্থঃ, তেষাং‌ কর্মণোऽঙ্গভূতত্বাৎ‌… তেষাং‌ য়োऽর্থঃ স‌ যদ্যপি‌ কর্মণো‌ নঙ্গভূতঃ, তথাপি‌ তে‌ তমেব‌ প্রতিপাদ্যন্তঃ কর্মণোऽঙ্গত্বং‌ প্রতিপদ্যন্তে‌, নোচ্চারণমাত্রেণ‌ ।
এর অভিপ্রায় হলো‌, মন্ত্র‌ তার‌ অর্থের‌ কারণ‌ই কোনো ক্রিয়ার‌ অঙ্গভূত‌ অর্থাৎ, তাতে‌ সমন্বিত হতে‌ পারে‌ ।
 
৬. ঋগ্বেদ‌ ১/১/১ নং মন্ত্রের‌ বেঙ্কটমাধব ভাষ্য‌ —-
" বিনিয়োপরিজ্ঞানাদ্‌ য়জুষামর্থনিশ্চয়ঃ ।
ইতিহাসৈর্ঋগর্থানাং‌ বহুব্রাহ্মণদর্শিতৈঃ ।।
অর্থাৎ, বিনিয়োগজ্ঞান‌ দ্বারা‌ যজু মন্ত্রসমূহের‌ অর্থ‌ জানা যায়‌ এবং ব্রাহ্মণ প্রদর্শিত‌ ইতিহাস‌ দ্বারা‌ ঋগ্বেদ‌ মন্ত্রের‌ অর্থ‌ জানা যায় ।
 
৭. ভট্টভাস্করকৃত‌ তৈত্তিরীয় সংহিতা‌ ভাষ্য‌ পৃষ্ঠা‌. ৩ –
মন্ত্রবাচ্যোऽর্থো‌ দেবতা‌, বিনিয়োজকং‌ ব্রাহ্মণম্‌ । তত্রৈকৈব‌ দেবতা‌, অগ্নি-বায়ু‌-সূর্যরূপেণ‌ বিভক্তা‌ সর্বত্র‌ ব্যাখ্যাতব্যা‌ । তাসাং‌ বিভূতয়ঃ পৃথিব্যন্তরিক্ষদ্যু‌ স্থানস্থাঃ অন্যা‌ দেবতা‌ ইতি‌ নৈরুক্তাঃ । তাশ্চ‌ প্রতিমন্ত্রং‌ লিঙ্গগৈর্বিনিয়োগেন‌ চ‌ গম্যন্তে‌ চ‌ জ্ঞায়ন্তে‌ চ‌ ।
অর্থাৎ, ব্রাহ্মণগ্রন্থ‌ বিনিয়োজক‌ । … দেবতা‌ লিঙ্গ‌ এবং বিনিয়োগ‌ দ্বারা‌ জানা সম্ভব ।
 
৮. তৈত্তিরীয় সংহিতা‌র‌ সায়ণকৃত ভাষ্য‌ ভূমিকা‌য় —
 
ক. য়দ্যপি‌ মন্ত্রবিনিয়োগা‌ ব্রাহ্মণেসর্বেऽপি‌ নাম্নাতাঃ । তথাপি‌ কল্পসূত্রকারৈব্রহ্মিণান্তরপর্য়ালোচনয়া‌ সর্বেऽভিহিতাঃ । অতো‌ বৌধায়নাদিসূত্রোদ্ধরণাদিপূর্বকং ……
 
খ. সায়ণকৃত‌ ঋগ্বেদভাষ্য ভূমিকা‌ পৃষ্ঠা. ৫১ ( কাশীসংস্করণ‌ )
" অতঃ কল্পসূত্রং মন্ত্রবিনিয়োগেন ঋত্বনুষ্ঠানমুপদিশ্য উপকরোতি। তর্হি " প্রবোবাজা" ইত্যাদীনাং সামিধেনীনাম্ ঋচামেব বিনিয়োগমাশ্বলায়নো ব্রবীতু " নমঃ প্রবক্তে" ইত্যাদয়স্ত্বনাম্নাতাঃ কুতো বিনিযুজ্যন্তে (আশ্বলায়নসূত্র ১/২) ইতি চেৎ নায়ং দোষঃ, শাখান্তরসমাম্নাতানাং ব্রাহ্মণান্তরসিদ্ধস্য বিনিয়োগস্য গুণোপসংহারন্যায়েন অত্র বক্তব্যত্বাত্ সর্বশাখাপ্রত্যেকং কর্ম ইতি ন্যায়বিদঃ। তস্মাত্ শিক্ষেব কল্পোহপি অপেক্ষিতঃ।।"
 
অর্থাৎ, তৈত্তিরীয় সংহিতার‌ ভাষ্যের‌ ভূমিকায়‌ সায়ণ‌ বলে‌, ব্রাহ্মণে সব মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ‌ উপলব্ধ‌ নয় । অতঃ ব্রাহ্মণান্তরের‌ পর্যালোচনের মাধ্যমে‌ অন্য‌ মন্ত্র সমূহের‌ বিনিয়োগ‌ জানা আবশ্য‌ক‌ ইত্যাদি‌ । ঋগ্বেদ ভাষ্যের‌ ভূমিকায়‌ সায়ণ লিখে‌, কল্পসূত্র‌ দ্বারা‌ মন্ত্রসমূহের‌ বিনিয়োগ সম্বন্ধিত জ্ঞান প্রাপ্ত‌ হয়ে থাকে, যা‌ ব্রাহ্মণান্তরে‌ উদ্ধৃত বিধায় গ্রাহ্য‌ ইত্যাদি ।
 
গ. কাণ্বসংহিতার সায়ণকৃত ভাষ্যভূমিকা পৃষ্ঠা. ১১৫ —
 
" অত্র বৌধায়ন উভয়োর্বাক্যয়োরেকমন্ত্রত্বমাশ্রিত্ব তত মন্ত্রচ্ছেদনে বিনিয়ুঙ্ ক্তে। তামাচ্ছিনত্তীষে ত্বোর্জে ত্বেতি। আপস্তম্বস্তু তদভিসন্ধায় মন্ত্রভেদপক্ষমপি কঞ্চিদাশ্রিত্য বিনিয়োগভেদমাহ.. ইষেত্বোর্জেত্বেতি তামাচ্ছিনত্ত্যূর্জেত্বেতি সংনমত্যানুমাষ্টি বেতি সন্নমতঃ সান্নায়্যনামকং দধিরূপং হবিঃ কুর্বত ইত্যর্থঃ।
কাণ্বশিষ্যাস্তু‌ মন্ত্রভেদং‌ বিনিয়োগভেদং‌ চাশ্রিত্যেত্তথমামনন্তি‌ তামাচ্ছিনত্তীষে‌ত্বেতি‌ বৃষ্টয়ে‌ তদাহ‌ য়দিষে‌ ত্বেত্যুর্জে‌ ত্বেত্যনুমার্বি য়দ্‌দ্দব্ট্যা ঊর্করসো‌ জায়তে‌…. । "
 
অর্থাৎ, বৌধায়ন‌ এখানে‌ " ইষে‌ ত্বা‌ ঊর্জে‌ ত্বা‌ " একে‌ একটি মন্ত্র মেনে‌ শাখাছেদনে‌ নিযুক্ত‌ করেছেন এবং আপস্তম্ব‌ একে‌ দুটি‌ ভিন্ন‌-ভিন্ন‌ মন্ত্র মেনে‌ " ইষে‌ ত্বা‌ " দ্বারা‌ শাখাছেদন‌ করা উচিত এবং " ঊর্জে ত্বা‌ " দ্বারা‌ যথার্থ অনুমান করা উচিত । সুতরাং, এখানে‌ বিনিয়োগভেদ‌ এবং মন্ত্রভেদ‌ এর উল্লেখ রয়েছে ‌ । এই বচন‌ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য ।
 
এ ছাড়াও‌ সায়ণকৃত‌ ঋগ্বেদ ভাষ্য প্রত্যেক সূক্তের‌ প্রারম্ভে‌ আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রের আধারে‌ তথা‌ কোথা‌ও-কোথাও‌ লিঙ্গোক্ত‌ বিনিয়োগের‌ উল্লেখ বিদ্যমান । অর্থাৎ, সায়ণভাষ্যেও‌ কোথাও‌ গোপথ‌, কোথাও কোথাও‌ অন্যাদি‌ গ্রন্থ‌ দ্বারা‌ প্রায়ঃ সব সূক্তে‌র প্রারম্ভে‌ই বিনায়োগের‌ স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ‌ ।
 
উব্বট মহীধরকৃত‌ যজুর্বেদ ভাষ্যেও‌ কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রের‌ আধারে‌ বিনিয়োগ‌ দর্শানো‌ রয়েছে ।
  • পূর্বোক্ত‌ বিনিয়োগ‌ প্রকরণের‌ বিবেচন

১. উপর্যুক্ত‌ এইসব‌ প্রকরণে নিরুক্ত‌ এবং বৃহদ্দেবতা‌‌ই মুখ্যতয়া‌ বিচার‌ যোগ্য । বৃহদ্দেবতা‌য়‌ অনেক সাধারণ‌ রীতি‌তে বিনিয়োগ নিরূপণ‌ উপলব্ধ‌ । কেবল এতটুকুই যে‌, মন্ত্র‌ কর্মের বিনিয়োগকে‌ বলা হয় তথা‌ ( ৮/১০ ) নং মন্ত্র তার‌ স্বঅর্থ দ্বারা‌ উক্ত‌ ক্রিয়ার অনুধাবনে‌ সমর্থ‌ থাকে‌, " শক্তিপ্রকাশনেনৈষাং‌ " এর এই-ই অর্থ‌ ।
 
নিরুক্ত‌ ১/৮ নং শ্লোকে‌ যে‌‌ বিনিয়োগ‌ শব্দের‌ উল্লেখ রয়েছে, এর‌ অর্থ‌ নিয়ত‌ বা‌ নিযুক্তি‌ মাত্র‌ । মন্ত্র‌ তার‌ পদসমূহের‌ অর্থ স্পষ্ট নির্দেশ করছে যে‌, আমাকে‌ যজ্ঞের‌ ঋত্বিজগণের‌ কর্ম‌ বা পৃথক-পৃথক‌ বিভাগে প্রয়োগ‌ করো‌, কেননা তা‌ সেটাই নির্দেশ করছে ।
 
নিরুক্ত ৭/২০ নং শ্লোকে বর্ণনা‌ করা হয়েছে – " তদে‌তদেকমেব‌ জাতবেদসং‌ গায়ত্রং‌ তৃচং‌ দশতয়ীষু‌ বিদ্যতে‌ । য়ত্তু‌ কিঞ্চিদাগ্নেয়ং‌ তজ্জাতবেদসানাং স্থানে‌ য়ুজ্জতে‌ " ।
অর্থাৎ - গায়ত্রী‌ ছন্দযুক্ত‌ যা‌ এ‌ক‌ই তিন‌ ঋচার‌ সূক্ত‌ জাতবেদাঃ দেবতাযুক্ত‌ সমগ্র ঋগ্বেদে‌ বিদ্যমান। যেটা অগ্নি‌ দেবতার‌ সূক্ত‌, সেটাই‌ জাতবেদাঃ‌ দেবতাযুক্ত‌ প্রকরণে‌র‌ সহিত সম্বন্ধ । অর্থাৎ, অগ্নি‌ এবং জাতবেদাঃ দুটি ভিন্ন-ভিন্ন দেবতা‌ । এক দেবতাযুক্ত‌ ঋচা‌ অন্য দেবতাযুক্ত‌ ক্রমে কিভাবে বিনিয়ুক্ত‌ হতে পারে । অতঃ তার‌ স্থানে‌ অগ্নি‌ দেবতাযুক্ত‌ ঋচা‌র‌ সূক্ত‌ প্রযুক্ত‌ করা হয়ে থাকে ।
 
" তদেতদেকমেব‌ বৈশ্বদেবং‌ গায়ত্রং‌ তৃচং‌ দশতয়ীষু‌ বিদ্যতে‌ । য়ত্তু‌ কিঞ্চিদ্‌ বহুদেবতং‌ তদ্বৈশ্বদেবানাং‌ স্থানে য়ুজ্যতে‌ । য়দেব‌ বিশ্বলিঙ্গমিতি‌ শাকপুণি‌রনত্যন্তগতস্ত্বেষ‌ উদ্দেশো ভবতি‌ । " ( নিরুক্ত‌ ১২/৪০ )
এর‌ও অর্থ‌ এক‌ই, কেবল‌ জাতবেদাঃ এর স্থানে‌ বৈশ্বদেব‌ পদের উল্লেখ রয়েছে । সুতরাং, যেখানে‌ বৈশ্বদেব‌ দেবতা বিশিষ্ট সূক্ত‌ বা মন্ত্রের প্রয়োজন হয়, সেখানে‌ বহুদেবতা বিশিষ্ট সূক্ত‌ বা মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ হবে ।
 
 শাকপুণি‌ এটাও‌ মেনেছেন‌ যে‌, যে‌ সূক্ত বা মন্ত্রে বিশ্ব শব্দের পাঠ‌ উপলব্ধ, সেটাও‌‌ " বিশ্বেদেবাঃ " দেবতা বিশিষ্ট সূক্ত‌ মেনে বিনিয়োগ আবশ্যক ।
 
 
নিরুক্তের‌ এই দুইটি স্থলে এটা স্পষ্ট যে‌, মন্ত্র সমূহের‌ বিনিয়োগ প্রণালী‌ মহর্ষি যাস্কের‌ সময়ে‌ও বিদ্যমান ছিলো । তথা‌ তাতে‌ অর্থের‌ প্রধানতা‌‌ই মুখ্য‌ কারণ‌ । অন্য‌ দেবতা‌ বিশিষ্ট মন্ত্রকে ভিন্ন দেবতা বিশিষ্ট মন্ত্রের‌ স্থানের বিনিয়ুক্ত‌ করা অনুচিত । বিনিয়োগ অর্থের‌ প্রধানতা‌ গ্রহণ পূর্বক সঠিক অর্থ নিরূপণ করা সম্ভব । বৃহদ্দেবতা‌ এবং নিরুক্তের‌ উপর্যুক্ত‌ সব স্থলে‌ এ‌ই বিষয়‌ই ব্যক্ত‌ করা হয়েছে ‌।
২. বাকি ‌র‌ইল‌ সর্বানুক্রমণীর‌ উক্তি‌ । যদ্যপি এর‌ মূল‌ ঋকসর্বানুক্রমণীতে‌ বিনিয়োগ‌ বিষয়ে‌ স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই, তথাপি‌ প্রারম্ভে ব্যক্ত‌ হয়েছে —-
" নহ্যেতজজ্ঞানমৃতে‌ শ্রৌতস্মার্ত্তকর্মপ্রসিদ্ধিঃ । মন্ত্রাণাং ব্রাহ্মণার্ষেয়ছন্দোবিদ্যাজনাধ্যাপনাম্যাং শ্রেয়োऽধিগচ্ছনীতি‌ ।
অর্থাৎ, শ্রৌত‌ স্মার্ত্ত‌ কর্মের‌ প্রসিদ্ধি ঋষি‌ দেবতা‌ ছন্দঃ জ্ঞান বিনা‌ অসম্ভব, ব্রাহ্মণ দ্বারা‌ ঋষি দেবতা‌ ছন্দের‌ জ্ঞান‌ কল্যাণের মাধ্যমে দেওয়া হয় । এতে‌ ব্রাহ্মণের‌ বিনিয়োজক‌ ( বিনিয়োগ‌ ) বলা হয়েছে । ঋকসর্বানুক্রমণীর‌ টীকা‌য় যেখানে যেখানে‌ বিনিয়োগের‌ উল্লেখ বিদ্যমান‌ সেখানে‌ সেখানে‌ উক্ত‌ সূক্ত‌ বা মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ প্রদর্শন হয়েছে, আর কিছুই নয় ।
যজু্ঃ সর্বানুক্রমণীকার‌ অতি স্পষ্ট শব্দে‌ " বিনিয়োগ‌ঃ কল্পকারোক্তঃ " উল্লেখ করেছেন । পরন্তু আরম্ভের‌ প্রথম মন্ত্রের বিনিয়োগ এবং দেবতা‌ শাখা । অর্থাৎ, দেবতা‌‌ও শাখা উল্লেখ করা হয়েছে, এবং শাখাছেদনেই এই মন্ত্রের বিনিয়োগ‌ও দর্শিত হয়েছে, যা‌ ঠিক‌ নয় ।
কেননা, শতপথ ব্রাহ্মণে‌ বর্ণনা হয়েছে –
" য়স্যৈ হবির্দীয়তে‌ সা‌ দেবতা‌ " । অর্থাৎ, যার‌ প্রতি হবি প্রদান করা হয়, তাকে দেবতা‌ বলা হয় ।
শবর স্বামী কৃত মীমাংসা ভাষ্যে বর্ণন হয়েছে –
" য়স্যা‌ বাচকং‌ শব্দমুদ্দিশ্য‌ স্মৃত্বা‌ বা‌ হবিস্তল্লক্ষ্যমিতি‌ সঙ্কল্পঃ ক্রিয়তে‌ সা‌ দেবতা‌ ভবতি‌ " ( মীমাংসা: ১০/৪/২৩ শবর‌ ভাষ্য‌ ) এর অর্থ‌ও এক‌ই যে‌, যাকে‌ লক্ষ্যপূর্বক‌ হবি প্রদান‌ করা হয়, তাকে‌ই দেবতা‌ বলা হয় ।
সুতরাং‌ শাখার‌ হবি‌ প্রদান করা হয় না, যা‌ প্রাচীন‌ বৈদিক সম্প্রদায় বিশেষজ্ঞ স্পষ্টভাবেই জ্ঞাত ছিলেন‌, কেননা‌, " ইদং‌ শাখায়ৈ‌ স্বাহা‌, ইদং‌ শাখায়ৈ‌ ইদন্ন‌ মম " এমনটা কোনো শ্রৌত-গৃহ্য-মীমাংসার বিদ্বান‌, বেদের‌ বিদ্বান আজ পর্যন্ত‌ মান্যতা দেন নাই, কোথাও‌ উপলব্ধ নয় । আর‌ এমনটা মানা সম্পূর্ণ অনুচিত । " শাখায় বিনিয়ুক্ত‌ মন্ত্র‌ বিদ্যমান‌ " এমনটা মানলে‌ তা সঠিক । শাখা দেবতা নয় । এই বিষয়ে‌ নিরুক্ত‌ ৭/৪ এর দুর্গাচার্য‌ এবং স্কন্দ স্বামীর‌ টীকাও‌ দ্রষ্টব্য। । দুইজন‌ই " ইষে‌ ত্বা " মন্ত্রের শাখায় বিনিয়ুক্ত মেনেছেন ।
যজুঃ সর্বানুক্রমণী‌তে উল্লেখিত পরবর্তী দুই উদাহরণ মন্ত্রবিশেষ‌ বা কর্মবিশেষ এর বিনিয়োগ‌ই দর্শিয়েছে । যদি‌‌ও তৃতীয় উদাহরণে বর্ণিত‌ হয়েছে যে‌, দেবতা‌র জ্ঞান‌ মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ দ্বারা‌ও হয়ে‌ থাকে । কিন্তু প্রধানতয়া‌ দেবতা‌র জ্ঞান‌ মন্ত্রের‌ অর্থের উপর আশ্রিত । এটা ঠিক নয়, তা ব্যক্ত করেছেন‌ যজুঃ সর্বানুক্রমণীর‌ টীকাকার‌ অনন্তদেব‌ ।
এখানে এতটুকুই বলা শ্রেয়‌ যে‌, সর্বানুক্রমণীকারক গণ‌ বিনিয়োগ বিষয়ে‌ কল্পকারক‌দেরই মত গ্রহণ পূর্বক তত্তৎ‌ মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ‌ বর্ণনা করেছেন ।
উপরোক্ত‌ বর্ণনা‌য় স্পষ্ট প্রতীয়মান যে‌, বেদ ভাষ্যকার‌ স্কন্দস্বামী‌, মাধব‌, ভট্টভাস্কর‌ এবং সায়ণাদি‌ বিনিয়োগ‌ বিষয়ে‌ এক‌ই মন্তব্য‌ করেছেন‌ যে‌, মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ‌ সম্বন্ধে জানা ব্যতীত‌ মন্ত্রের‌ অর্থ‌ জানা অসম্ভব । স্কন্দ স্বামী বেদ মন্ত্রের‌ অর্থকে‌ কর্মের‌ অঙ্গভূত‌ মেনেছেন ; অর্থাৎ, যদি‌ কোনো মন্ত্রের‌ পদ‌ বিনিয়ুজ্যমান ক্রিয়াকে‌ সমর্থন না করে‌ তাহলে‌ তার বিনিয়োগ‌ ঠিক‌ নয় । ভট্টভাস্কর‌ " বিনিয়োজকং‌ ব্রাহ্মণম্‌ " শব্দটি উল্লেখ করে ব্রাহ্মণের‌ প্রতিপাদিত্য‌ বিষয়কে‌ স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন । সায়ণ‌ সম্পূর্ণ বেদ‌ তথা‌ সংহিতা ভাষ্যের ভূমিকায় একটি স্পষ্ট বিষয় তুলে ধরছেন‌ যে‌, ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে সব প্রকারের‌ বিনিয়োগ উল্লেখ নেই, দ্বিতীয়ত কল্পসূত্রকার‌ গণ যে‌ বিনিয়োগ‌ দর্শিয়েছেন‌, তা‌ তাঁদের স্ব স্ব শাখা‌র ব্রাহ্মণ অতিরিক্ত অন্য‌ শাখার‌ নির্দিষ্ট বিনিয়োগের‌ ভিত্তিতে‌‌ই বর্ণনা হয়েছে । সায়ণের মতানুসারে‌ কল্পসূত্রের‌ সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ‌ এটাই যে।, তা‌ মন্ত্রের বিনিয়োগকে‌ বর্ণনা করে ।
শতপথ‌ ব্রাহ্মণ যজুর্বেদ‌ এর কেবল‌ ১৮ অধ্যায় পর্যন্ত‌ তত্তৎ‌ মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ তত্তৎ‌ ক্রিয়ায় বর্ণখিত হয়েছে । পরবর্তী অধ্যায়ের‌ মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ নিয়ে কেনো বর্ণিত হয় নাই ? কি কারণে‌ এরূপ হতে পারে ? এবং কেনো‌ই বা‌ ১৮ অধ্যায়‌ পর্যন্ত মন্ত্রের অর্থের‌ বর্ণনা হয়েছে ‌ । যখন‌ "" অগ্নিচয়ন‌ "" আদি ক্রিয়া বর্তমানে উপলব্ধ এবং কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রকার‌ সমগ্র বাজসনেয়ী সংহিতার‌ সম্পূর্ণ মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ দর্শিয়েছেন‌ তাহলে‌ শতপথকার‌ কি কারণে দর্শান নাই ?
মত‌ এই যে‌, আঠারো অধ্যায়ের পরবর্তী অধ্যায় গুলোর‌ মন্ত্রের‌ অর্থ উক্ত‌ ক্রিয়া‌-কর্মের সাথে‌ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং কল্পকার‌ কাত্যায়ন‌ আদি‌ সেই সেই মন্ত্রের‌ নির্দিষ্ট কর্মের‌ বিনিয়োগ করেছেন ।
এখন‌ মহর্ষি যাস্ক‌ এবং মহর্ষি পতঞ্জলি আদি মহর্ষিগণ বিনিয়োগ সম্বন্ধে‌ কিরূপ বর্ণনা করেছেন তা‌ দর্শানো হচ্ছে ।

যাস্ক‌-পাণিনি-পতঞ্জলি এবং যজ্ঞ

নিশ্চয়‌ই ব্রাহ্মণগ্রন্থ ( সব নয় ) যাস্ক-পাণিনি‌-পতঞ্জলির সময়কালের পূর্বে । ব্রাহ্মণ কালে‌ যজ্ঞের‌ স্বরূপ কেমন‌ ছিলো‌, যা‌ এক গম্ভীর‌ বিচার্য‌ বিষয় বটে‌ । পুনরপি শতপথের বিবিধ‌ স্থলে‌ যজ্ঞের ‌ আধ্যাত্মিক স্বরূপের‌ নির্দেশ উপলব্ধ । ' য়ৎ‌ পিণ্ডে‌ তদ্‌ ব্রহ্মাণ্ডে " যা‌ পিণ্ডে তা ব্রহ্মাণ্ডে বিদ্যমান ।
মহর্ষি যাস্ক‌ নিরুক্তের‌ ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে‌ কেবল‌ দেবতা বিষয়ে বর্ণনা‌ করেছেন । এতে‌ ( মাহাভাগ্যাদ্দেবতায়া এক ‌ আত্মা‌ বহুধা‌ স্তুয়তে একস্যাত্মনোऽন্যে‌ দেবাঃ প্রত্যঙ্গানি ভবন্তি । নিরুক্ত‌. ৭/৪ ) সেই সময়কাল‌ পর্যন্ত দৈবত‌ কাণ্ডের‌ ব্যাখ্যাত‌ ১৫১ দেবতাবাচী‌ শব্দ‌ এক আত্মার‌ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে তুলনা করা হয়েছে । কিন্তু নিরুক্তে এর পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা করা হয়েছে । যা‌ বহুদেবতাবাদের‌ দ্যোতক‌ । যাস্কের‌ সময়‌ও বহুদেবতাবাদের‌ সিদ্ধান্তের প্রচলন ছিলো । এ কারণে‌ যাস্ক‌ ( নিরুক্ত‌. ৭/২০ ) জাতবেদ বিশিষ্ট এক‌ই গায়ত্র সূক্ত‌ ঋগ্বেদে‌ থাকার‌ দরূণ আগ্নেয়‌ ( অগ্নিদেবতা‌ ) সূক্তের‌ বিনিয়োগ‌ করা উচিত এমনটা বর্ণনা করেছেন‌, মহর্ষি যাস্কের‌ বচনানুসারে‌ তথা নিরুক্তের‌ ১. য়ৎ‌কাম‌ ঋষির্য়স্যাং‌ দেবতায়ামার্থপত্যমিচ্ছন্‌‌ স্তুর্তি‌ প্রয়ুঙ্কতে‌ তদ্দৈবতঃ স‌ মন্ত্রো‌ ভবতি ( নিরুক্ত‌ ৭/১ ) তথা ( ২ ) " অথাপি‌ য়াজ্ঞে‌ দৈবতেন‌ বহবঃ প্রদেশা‌ ভবন্তিঃ ; তদেতেনোপে‌ক্ষিতব্যম্‌ । তে‌ চেদ‌্‌ ব্রুয়ুর্লিঙ্গ‌ জ্ঞাস্ম ইতি‌…. বায়ুলিঙ্গ‌…. চেন্দ্র‌লিঙ্গ‌ চাগ্নেয়ে‌ মন্ত্রে । ( নিরুক্ত. ১/১৭ ) ইত্যাদি‌ বিবিধ স্থল পর্যবেক্ষণ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে‌, যাস্কের‌ সময়কালে‌ যজ্ঞের‌ বিবিধ‌ প্রকার‌ বিস্তার‌ বিদ্যমান ছিলো । যজ্ঞের‌ জন্য দেবতার আবশ্যকতা‌ রয়েছে এবং তা‌ পৃথক-পৃথক অর্থাৎ, দেবতার পৃথক‌ সত্তা‌র সিদ্ধান্ত অবশ্য‌ই বিদ্যমান ছিলো, হোক‌ সেটা এক‌ই আত্মার‌ পৃথক-পৃথক‌ অঙ্গ মানা ।
পাণিনী‌ মুনি‌ " সাস্য‌ দেবতা‌ " ( অ. ৪/২/২৪ ) " তদর্থ‌ বিকৃতেঃ প্রকৃতৌ‌ " ( অ‌. ৫/১/১২ )
ইত্যাদি‌ সূত্রের‌ নির্দেশ দ্বারা‌‌ও এটাই বোধগম্য হয় যে‌, যা‌ উপরে‌ বর্ণনা করা হয়েছে তার‌ই প্রমাণ নির্দেশ করছে । ভগবান পতঞ্জলি‌‌ও যজ্ঞ‌ বিষয়ে‌ বেশ কিছু প্রকরণ‌ বর্ণনা করেছেন । " বেদানধীত্য‌ ত্বরিতা‌ বক্তারো‌ ভবন্তি‌ " পুরাকল্পে‌ এমন ছিলো যে‌, বেদারম্ভ‌ সংস্কারের‌ পশ্চাৎ‌ ব্রাহ্মণ‌ ব্যাকরণ‌ অধ্যয়ন‌ করতেন‌ । বর্তমানে এমনটা দেখ যায়‌ না । বেদ‌ পড়েই‌ যেনো‌-তেনো‌ বচন‌ দেওয়া হয় । এমনটা বর্ণন করা ।
মহাভাষ্যকার‌ আর‌ও বর্ণনা‌ করেন‌ যে‌, ব্যাকরণাধ্যয়ন‌ এর মুখ্য‌ ৫টি প্রয়োজনে ( ঊহঃ তে চাবশ্যং‌ য়জ্ঞগতেন‌ পুরুষেণ‌ য়থায়থং‌ বিপরিণময়িতব্যাঃ ) অসন্দেহ‌তে‌ " য়াজ্ঞিকাঃ পঠন্তি‌ " স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে । পরবর্তীতে ১৩টি‌ প্রয়োজনে‌র প্রকরণেও মহাভাষ্যকার‌ যজ্ঞের‌ই প্রসঙ্গ দর্শিয়েছেন ।
এ দ্বারা‌ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হ‌ওয়া যায় যে‌, যাস্ক‌, পাণিনি‌ এবং পতঞ্জলি‌র সময়কালে‌ যজ্ঞের‌ প্রচলন‌ অত্যাধিক‌ এবং প্রচুর বিস্তার‌ বিদ্যমান ছিলো । সেই সময় যাস্ক‌ দ্বারা‌ দর্শানো উপর্যুক্ত‌ দুটি প্রমাণ ( নিরুক্ত‌ ৭/২০ তথা‌ ১২/৪০ ) অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ ।

বহুদেবতাবাদ‌ দ্বারা বিনিয়োগের‌ স্বরূপ পরিবর্তন, মীমাংসাকার‌ মহর্ষি জৈমিনির‌ মত

পূর্বের‌ বিষয়ে‌ যেটা দর্শানো হয়েছে যে‌, যাস্ক‌ একাত্মদেবতাবাদ‌ নিরূপণ‌ করে বহুদেবতাবাদ‌ প্রকরণ‌ মেনেছেন‌ । এই বিষয়ে‌ মহর্ষি‌ জৈমিনি‌ তাঁর মীমাংসা দর্শনে‌র ৯/১/৪ তথা‌ ১০/৪/২৩ দেবতাধিকরণে শব্দময়ী দেবতার‌ সিদ্ধান্ত‌ প্রতিষ্ঠা করে নিরুপণ করেছেন । অর্থাৎ, মন্ত্র‌কে‌ই ( শব্দময়‌ ) দেবতা মেনেছেন এবং সাথে‌ ইন্দ্র‌ এবং মহেন্দ্রকে পৃথক-পৃথক‌ মেনে‌ বহুদেবতাবাদের‌ই প্রতিপাদন‌ করেছেন । মীমাংসা শাস্ত্রের‌ এই প্রকরণে‌ বিগ্রহবতী‌ ( শরীরধারী‌ ) দেবতা‌ সম্ভব নয়, এই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট প্রমাণ করা হয়েছে ।
" বিধিশব্দস্য‌ ভাবঃ স্যাৎ‌ তেন‌ চোদনা‌ "
( মীমাংসা. ১০/৪/২৩ )
এই সূত্র‌ দ্বারা‌ শব্দময়ী দেবতা‌র সিদ্ধান্ত‌ স্পষ্ট প্রতিপাদন করা হয়েছে ।
মীমাংসা শাস্ত্রের‌ প্রসিদ্ধ‌ বিদ্বান তথা‌ ভাষ্যকার‌ শবরস্বামী বর্ণনা করেছেন –
" কা পুনরিয়ং দেবতা নাম দেবতামপ্যুপকারিণ্যাং চোদিতায়াংশব্দস্যৈব যজ্ঞ সম্বন্ধঃ। শব্দ এব হবিষা সম্বধ্যতে তত্সম্বন্ধাদ্ অর্থোঽপি দেবতা ভবিষ্যতি। য়স্য হি শব্দো হবিষা তাদর্থ্যন সম্বধ্যতে সা দেবতা। শব্দে কার্যস্যাসম্ভবাদ্ অর্থে কার্য বিজ্ঞায়তে। ইহ তু শব্দ এব কার্য সম্ভবতি।"
[ মীমাংসা শবরভাষ্য ১০/৪/২৩ দেবতাধিকরণে ]
এই বিষয়ে‌ ভাট্টদীপিকা‌র কর্ত্তা খণ্ডদেব‌ বিগ্রহবতী দেবতা‌র‌ খণ্ডন‌ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন –
" অতঃ কথমপি ন বিগ্রহাদিস্বীকারঃ। কিন্তু শব্দমাত্র দেবতা অর্থস্তু প্রাতিপদিকানুরোধাত্ চেতনোঽচেতনো বা কশ্চিত্ স্বীক্রিয়তে ন তু বিগ্রহাদিমান্। উপাসনাদো পরমধ্যানমাত্রমাহার্য তস্যেতি জৈমিনিমত- নিষ্কর্ষঃ। মম ত্বেবং বদতোঽপি বাণী দুষ্যতি ইতি হরিস্মরণমেব শরণম্। "
শবর‌ তথা‌ খণ্ডদেব‌ দুইজন‌ বিদ্বানের‌ বর্ণনা দ্বারা‌ স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, দেবতা‌কে তাঁরা শব্দময়ী মেনেছেন এবং এটাই জৈমিনির‌ মতো‌ ।
খণ্ডনদেব‌ ইনিয়ে-বিনিয়ে বর্ণনা করেছেন –
" এ কারণে‌ দেবতা‌ শরীরধারী‌ ( বিগ্রহবতী ) হয়ে থাকে‌, এই বচন‌ কোনো প্রকারে‌ই স্বীকার‌ করা অসম্ভব । দেবতা‌ শব্দমাত্র‌ । এটাই মানতে হবে । শব্দের প্রয়োগে অর্থের‌ বোধ‌ হয় । সুতরাং, প্রাতিপদিক‌ অনুসারে‌ চেতন‌ বা‌ অচেতন‌ যে‌ কোনো কিছুই মানা যায় । শরীরধারী‌ মানা‌ অসম্ভব । উপাসনাদিতে‌ তাঁর ধ্যান‌ ( কোনোরূপ মূর্তি‌ ছাড়াই ) করা সম্ভব, যা‌ জৈমিনি‌ মুনির‌ মত । এসব সত্য‌ উদ্ধৃতিতে আমার পাপ বোধ‌ হচ্ছে, এজন্য প্রভুর‌ স্মর‌ণ‌ই আমার শরণ‌ ।"
বহুদেবতাবাদের‌ সিদ্ধান্ত থেকে সৃষ্টি হ‌ওয়া বিবিধ‌ প্রকার‌ বিঘ্ন‌কে জৈমিনি‌ মুনি‌ শব্দময়ী‌ দেবতা‌ হিসেবে বর্ণনা করে তা দূরীভূত করেছেন‌ । বিগ্রহবতী দেবতা‌র বিচার ‌ যাস্কের সময়কাল থেকে প্রচলন ছিলো, এমনটা‌ দৈবত‌ কাণ্ডের‌ প্রথম অধ্যায়ে‌ই স্পষ্ট প্রতীয়মান । পরন্তু‌ দেবতা‌ শরীরধারীও হ‌ওয়া সম্ভব‌ ( মন্ত্রের‌ প্রতিপাদ্য‌ বিষয়‌ ) ; অশরীরধারী‌ও । অত‌এব‌ নিরুক্তকার‌ দেবতাকে‌ দুই প্রকারে‌ বিভক্ত করেছেন ।

মীমাংসা এবং বহুদেবতাবাদ‌

যেমনভাবে‌ নিরুক্তকার কর্তৃক প্রতিপাদিত‌ " মাহাভাগ্যাদ্দেবতাথা‌ এক‌ আত্মা‌ বহুধা‌ স্তুয়তে‌ " ( নিরুক্ত‌. ৬/৪ ) এক আত্মার‌ দেবতা‌ মেনে‌ ভিন্ন-ভিন্ন‌ ১৫১টি দেবতার‌ নিরুপণ‌‌ যাস্ক‌ ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে‌ বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, সেই প্রকারে‌ জৈমিনি‌ মুনি‌ শব্দময়ী‌ দেবতা মেনে‌‌ও ইন্দ্র‌ এবং মহেন্দ্রকে‌ পৃথক‌ পৃথক‌ দেবতা‌ মেনেছেন‌ । মীমাংসা. ২/১/১৬ নং সূত্রে‌‌ " ইন্দ্রস্য‌ নু‌ বীর্য়াণি‌ প্র‌ বোচম্‌ " ( ঋ. ১/২/২৬ ) এই মন্ত্রের‌ উপর স্তুতশস্ত্রাধিকরণ‌ ( মীমাংসা. ২/১/১৩-২৯ )সূত্রের‌ ভাষ্যে শবর‌ স্বামী‌ বর্ণনা করেছেন –
'ন চায়মিন্দ্রশব্দোঽভিহিতবৎ স্বার্থ তদ্ধিতার্থেন সম্বধ্যেত বিহিত বচ্চ পরার্থ মহত্ত্বেন সম্বদ্ধনূদ্যেত বিস্পষ্টশ্চায়মন্যোঽর্থো মহেন্দ্রো ভবতি.. তস্মাদ্ দেবতান্তরমিন্দ্রান্ মহেন্দ্রঃ ।...তথা বেদস্যাদিমত্তা দোষঃ প্রসজ্যেত । অতোঽন্য ইন্দ্রো মহেন্দ্রাৎ ।'
অর্থাৎ, ইন্দ্র‌ থেকে মহেন্দ্র দেবতান্তর‌ । মহান‌ গুণযুক্ত‌ ইন্দ্র‌‌ই মহেন্দ্র‌ হয়ে‌ থাকে‌ তা‌ নয়, যা‌ উপর্যুক্ত‌ লেখের‌ ভাব‌ । যখন‌ থেকে বিশেষণ‌-বিশিষ্ট‌ দেবতাগণকে‌ ভিন্ন‌ দেবতা‌ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়, তখন‌ থেকে বিনিয়োগভেদ‌ও হ‌ওয়া শুরু হয় । এই বিষয় নিরুক্ত‌ কালে‌ও প্রচলন‌ ছিলো । যখন‌ মন্ত্রের‌ অর্থের‌ প্রধানতা‌ না থাকে‌, তখন‌ বিনিয়োগের‌ প্রক্রিয়া‌র‌ বিঘ্নতার‌ উদ্ভব হয় । ইন্দ্র‌ এবং মহেন্দ্র‌কে পৃথক‌ হিসেবে মান্যতার‌ প্রবৃত্তি‌‌ও তখন‌‌ই হয়েছে ।
মীমাংসা. ১০/৪/২৩ নং সূত্রের‌ শবরভাষ্যে‌ বর্ণনা হয়েছে –
'সন্তি চাগ্নেরভিধানানি অগ্নিঃ শুচিঃ পাবকঃ, ধূমকেতুঃ কৃশানু:, বৈশ্বানরঃ, শাণ্ডিল্য ইত্যেবমাদীনি । তত্র সন্দেহঃ । বাচিষু নিগমেষু কিং যেন কেন চিদগ্নেঃ শব্দেনাভিধানং কর্তব্যমুত বিধিশব্দেনাগ্নিশব্দসেনেতি । অগ্নিশব্দেন হবিষ: সম্বন্ধঃ | নাস্তি প্রসঙ্গঃ শুচ্যাদীনাং শব্দানা মিতি । তস্মান্ মন্ত্রত্বে বিধিশব্দ উপাদাতব্য ইতি ।উচ্যতে ন ত্বেবং শব্দ এব দেবতা প্রাপ্নোতি । অত্রোচ্যতে । নৈতদস্মাভিঃ পরিহর্ত্তব্যম্| নহী বমুচ্যমানমস্মৎপক্ষং বাধতে । সুতরাং শুচ্যাদীনামপ্রসঙ্গ ইতি ।'
অর্থাৎ, অগ্নি‌ দেবতা‌র আহুতি তার পর্যায়বাচী‌ শুচি‌, পাবক‌, ধুমকেতু আদি দেবতাগণ‌ দ্বারা প্রদান‌ অনুচিত, কেননা‌ অগ্নি‌ এবং শুচি‌ আদি‌ ভিন্ন দেবতা ।
এখানে‌ প্রশ্ন উঠে‌ এই বিষয়ে‌ যে‌, ইন্দ্র‌ এবং মহেন্দ্র‌কে অথবা অগ্নি‌ এবং শুচি‌কে পৃথক‌ হিসেবে মান্যতা‌ দেওয়া ইন্দ্র‌ দেবতা বিশিষ্ট ঋচা‌ দ্বারা‌ অগ্নিসম্বন্ধী‌ গার্হপত্যাগ্নি‌র‌ উপস্থান বিধান‌ কিরূপ সম্ভব –
" এন্দ্র্যা গার্হপত্যমুপতিষ্ঠতে‌ " যা‌ ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে সর্বত্র বিধান উপলব্ধ । মীমাংসা শাস্ত্রে‌ও এই বিষয়ে‌ বিবিধ ব্যাখ্যান উপলব্ধ । তাহলে ইন্দ্র‌ দেবতা বিশিষ্ট ঋচা‌ দ্বারা গার্হপত্যাগ্নি‌র উপস্থান‌ কিরূপ সম্ভব ? যখন‌ ব্রাহ্মণ শাস্ত্র‌ তথা‌ যাস্কের মতানুসারেও‌ –
" য়ৎকর্ম‌ ক্রিয়মাণমৃগ্যজুর্বাভিবদতীতি‌ " ( নিরুক্ত‌. ১/১৬ ) দ্বারখ‌ স্পষ্টভাবে‌ মন্ত্রের‌ পদ সমূহের যে‌ সঠিক অর্থ‌ রয়েছে, তা সেই‌ ক্রিয়া‌তেই প্রয়োগে‌ সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে । কাল্পনিক‌ বিনিয়োগের‌ প্রারম্ভ‌ এখান‌ থেকে‌ই হয়েছে ।
এইসব গৌণী‌ কল্পনা দ্বারা‌ই করা হয়েছে । মূল‌ অর্থের‌ প্রাচীনতা‌ নষ্ট হ‌ওয়ায়‌ গৌণী‌ বৃত্তি‌র মাধ্যমে মন্ত্রের‌ বিনিয়োগের প্রচলন শুরু হয় । বেদার্থে যজ্ঞের প্রধানতার‌ থাকার‌ ফলে‌ এসব অনর্থ হয়েছে । না না ! যজ্ঞ‌ই বেদের‌ অর্থ‌, যা‌ পরবর্তীতে‌ প্রধান‌ ক্ষেত্রে প্রদান পেয়েছে । শতপথ‌ ব্রাহ্মণ‌ তথা অন্য‌ ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে‌ সব মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ উপলব্ধ নয় কেনো ? শতপথে কেবল‌ ১৮ অধ্যায়ের‌ বিনিয়োগের‌ বর্ণনা কেনো উপলব্ধ ? অন্য‌ ব্রাহ্মণ শাস্ত্রেও‌ বিনিয়োগ‌ নিয়ে খুব‌‌ই কম বর্ণনা বিদ্যমান । এসব প্রমাণ দ্বারা বিদিত হয় যে‌, যজ্ঞে‌ যেসব মন্ত্রের প্রয়োগ বিদ্যমান‌, সে সব মন্ত্রের‌ মূল‌ অর্থানুসারে‌ তার সাপেক্ষে সেই সেই ক্রিয়ায়‌ বিনিয়ুক্ত‌ হবে এবং যা‌ হবে না তা বিপক্ষে । এ কারণে‌ ব্রাহ্মণ‌ শাস্ত্রে‌ সব মন্ত্রের‌ বিনিয়োগের‌ বর্ণনা‌ নাই । শ্রৌতকারগণ‌ও তাঁদের স্ব স্ব শাখার সব মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ দর্শান নাই । তবে‌ কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্রে‌ যজুর্বেদ‌ এর ১৮ অধ্যায়ের‌ পরবর্তী অধ্যায় গুলোর‌ও বিনিয়োগ বর্ণিত হয়েছে । এ কারণ হতে পারে যে‌, বাচস্তোমপারিপ্লব‌, যেখানে‌ সমস্ত মন্ত্র‌ অর্থাৎ, মন্ত্রমাত্রের বিনিয়োগ কল্পনা‌ করা উচিত, সূত্রকার এমনটা বুঝাতে চেয়েছেন ‌।

সব মন্ত্রসমূহের বিনিয়োগের এক নবীন মার্গ বের করা হয়েছে

যবে থেকে দেবতাবাদের স্বরূপ এমনটা হয়ে গিয়েছিলো‌ যে‌, ইন্দ্র‌ মহেন্দ্র‌‌ দেবতা‌কে ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বা হিসেবে প্রচলন শুরু হয়েছে এবং মন্ত্রসমূহের বিনিয়োগ‌ হ‌ওয়া‌ আবশ্যক‌, এই ধারণার‌ প্রচলন শুরু হয় তথা সমাজে স্বীকৃতি পায়, তখন‌ থেকে‌ই ব্রাহ্মণ‌ এবং শ্রৌতসূত্রে যে‌সব মন্ত্রে বিনিয়োগ বিদ্যমান‌ তা ব্যতীত‌ অন্য‌ সব মন্ত্রের‌ সাপেক্ষে‌ও কিছু একটা‌ করা আবশ্যক‌, এই প্রশ্ন‌ উত্থাপিত হয় । এসব মন্ত্রের‌ও বিনিয়োগ আবশ্য‌ক ।
তখন‌ একটি মার্গের‌ উদ্ভাবন হয়, যাকে বাচস্তোম পারিপ্লব‌ বলা হয় —
১. সায়ণ‌কৃত‌ ঋগ্বেদভাষ্যভূমিকা‌য় বর্ণিত হয়েছে –
য়ঃ স্বাধ্যায়মধীয়ীতৈকাপ্যৃচম য়জুঃ সাম বা‌ তদ্ ব্রহ্ময়জ্ঞঃ' (তৈ. আর. ২|১০|৬) সোऽয়ং ব্রহ্ময়জ্ঞজয়ো অগ্নিমীডে
ইত্যমনায়ক্রমেণৈবানুষ্ঠেয়ঃ তথা সর্বা ঋচঃ সর্বাণি য়জুংষি‌ সর্বাণি‌ সামানি 'বাচস্তোমে পারিপ্লবং শংসতি' ইতি বিধীয়ন্তে তথা‌ আশ্বিনে সম্পতস্যমানে সূর্যো নোদিয়াদপি সর্বা দাশাতয়ীরনুব্রূয়াৎ ইতি (আপ. শ্রৌতসূত্র ১৪/১/২) বিধীয়তে....। ত্রিঃ স্বাধ্যায়ং বেদমধীয়ীত (তৈ. আরণ্যক ২/১৬) ইতি প্রায়শ্চিত্তস্য বেদপারায়ণম্ বিহিতম্।
এখানে‌ তৈ. আরণ্যকের‌ প্রমাণ‌ দ্বারা‌ ব্রহ্মযজ্ঞে সব মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ উল্লেখ করা হয়েছে তথা‌ বাচস্তোমে " যতক্ষণ‌ না সূর্যোদয়‌ হয় সম্পূর্ণ সংহিতার বিনিয়োগ হয়ে থাকে, প্রায়শ্চিত্তেও‌ । এমনটা সায়ণের লেখ‌ ।
২. শবরস্বামী কৃত মীমাংসা ভাষ্যে‌র‌ ২/১/২৩ নং সূত্রে‌র আনন্দাশ্রম সংস্করণের ৪ - ২৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত রয়েছে –
" সর্বেষাং‌ বাচস্তোমে‌ সর্বা‌ ঋচঃ সর্বাণি‌ য়জুংষি‌ সর্বাণি‌ য়জুংষি‌ সর্বাণি‌ সামানি‌ বাচস্তোমে‌ পারিপ্লবং‌ ( অশ্বমেধে‌) শংসতি‌ ইতি‌ তথা‌ য়স্যাশ্বিনে‌ শস্য‌মানে‌ সূর্য়ো‌ নোদিয়াদপি‌ সর্বা‌ দাশতয়ীরনুব্রূয়াদিতি ।…'
এখানে‌ও বাচস্তোমে‌ সমস্ত‌ ঋগ্বেদ‌, যজু্ঃ এবং সামের‌ বিনায়োগ উপলব্ধ ।
এই বিষয়‌ বেদের‌ অর্থ‌ পিছনে ফেলে‌ মন্ত্র শুধু যজ্ঞের ক্ষেত্রে‌ প্রযোজ্য‌, এমন ধারণার‌ প্রচলন হয় । এই-ই বেদের‌ প্রতি অনাস্থা উৎপন্ন করেছে‌ । মূলত এর আরম্ভিক মূল‌ কারণ‌ ব্রাহ্মণগ্রন্থ‌ই, যখন‌ অর্থকে গৌণ রূপে স্বীকার করে বিনিয়োগের প্রারম্ভ হয়েছে ।

ব্রাহ্মণ এবং শ্রৌতকারের পরস্পর বিরোধ

যখন‌ " এন্দ্র্যা গার্হপত্যমুপতিষ্ঠতে‌ " সিদ্ধান্ত রূপে গৃহীত হয়, যেমনটা পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে, তখন‌ আর‌ও একটি বিষমতা‌ সৃষ্টি হয় । পরস্পর ভিন্ন-ভিন্ন‌ দেবতার‌ বিনিয়োগের‌ মান্যতা‌ দিলে‌‌ও হানি হতো না । পরন্তু এরা একে‌ অপরের‌ কঠোরতম খণ্ডন করা শুরু করে।
ব্রাহ্মণ শাস্ত্রে যা‌ সতর্কতার সহিত পর্যবেক্ষন যোগ্য‌ –
১. শতপথ‌ আদি ব্রাহ্মণে‌ –
ক. তদু‌ তথা ন‌ কুর্য়াৎ‌
খ. তদ্বৈকে‌ পৃষ্ঠা. ১৮।২৫।২৬।২৯।৩৫ ( শতপথ‌. ১/৪/৪/৭ ) পর্যন্ত‌ এক নাদ‌ এর‌ প্রচলন বিদ্যমান, যা‌ সমস্ত ব্রাহ্মণে‌ উপলব্ধ । এর অর্থ‌ হল, যে‌ ক্রিয়াসমূহ কোনো মন্ত্র‌ দ্বারা তৈত্তিরীয়‌ সংহিতা দ্বারা সম্পন্ন হয়ে থাকে ‌ । এই প্রকরণ শতপথকার‌ স্পষ্ট‌ খণ্ডন‌ করেছেন‌, এটা এমনভাবে করা ঠিক নয়, আপনারা এমনভাবে করেন না । যেমনটা তিনি করেন‌ । " তদু‌ তথা‌ ন‌ কুর্য়াৎ‌ " এই বাক্য‌ শতপথে‌ কেবল‌ প্রথম‌ কাণ্ডেই চার‌ বার‌ উপলব্ধ ।
" তদু‌ তথা ন‌ কুর্য়্যাৎ‌ " " তদ্বৈকে‌ " শব্দগুলো অনেক বার‌ উপলব্ধ । নিজ শাখা বাদে‌ অপর শাখার‌ ক্রিয়া খণ্ডন‌ করার‌ তাৎপর্য কি ? ভিন্ন শাখার‌ ক্রিয়া‌ ভিন্ন‌, তাহলে‌ খণ্ডন কেনো ? শতপথকার‌ আর‌ও লিখেছেন - " তদু‌ তথা‌ ন‌ ব্রূয়াৎ‌ । মানুষং‌ হ‌ তে‌ য়জ্ঞ‌ কুর্বন্তি ব্যৃদ্ধং বৈ‌ তদ্‌ য়জ্ঞস্য‌ য়ন্মানুষং‌ " ( শতপথ‌ আজমের‌ সংস্করণ‌ ) অর্থাৎ, এমন না বলে‌ যে এরূপ‌, সেই যজ্ঞে মানুষ‌ ( প্রয়োগ‌ ) করে । মানুষ‌ কৃত‌ যজ্ঞ নাশ করে থাকে‌ ইত্যাদি ।
এই প্রকার‌ পাঠ‌ কেবল‌ শতপথ ব্রাহ্মণে‌‌ই অধিক সংখ্যক‌ বিদ্যমান এবং অন্যাদি ব্রাহ্মণেও‌ বহুত সংখ্যক বিদ্যমান । ব্রাহ্মণকে বেদ মান্যকারী‌ এই বিষয়কে ত্রিকালেও‌ কদাপি‌ খণ্ডন‌ করতে পারবে না । ভিন্ন-ভিন্ন শাখার‌ প্রচলন‌ হেতু‌ এমন বিষয় উপলব্ধ‌, এসবে‌ দেবতা‌ এবং বিনিয়োগ‌ আদির‌ ভেদ‌ হেতু‌ এমনটা উপলব্ধ । এই ভেদ‌ বাড়তে বাড়তে শ্রৌতসূত্র‌ এবং গৃহ্যসূত্রের‌ মধ্যে‌ও প্রবেশ করেছে ‌। এ‌ক‌ই মন্ত্রের‌ ভিন্ন-ভিন্ন বিনিয়োগ প্রদর্শনে জানা যায় যে‌, এই বিনিয়োগ অর্থ বোধগম্যতার সাধক নয়, বরং বাধক-ই হচ্ছে। যখন বিনিয়োগ থেকে অর্থের প্রতীতি হয়ে থাকে, তবে কি শ্রৌতসূত্রকারগণ সেই সেই মন্ত্রের অর্থ পরস্পর বিরুদ্ধ-ই বুঝেছিলেন? এদের পরস্পর ভেদের কিছু উদাহরণ এখানে দর্শানোর প্রযত্ন করা হচ্ছে –

" চত্বারি‌ শৃঙ্গা‌ " এর বিনিয়োগ

" চত্বারি শৃঙ্গা‌ " ( ঋগ্বেদ‌. ৪/৫৮/৩ ) এই মন্ত্রের বিনিয়োগ শ্রৌতসূত্রে‌ এবং গৃহ্যসূত্রে‌ উপলব্ধ –
১. নিরুক্তকার‌ মহর্ষি যাস্ক‌ একে‌ যজ্ঞপরক‌ হিসেবে সূচিত করেছেন‌, তদ্যথা‌ – চত্বারি‌ শৃঙ্গেতি‌ বেদা‌ বা‌ এতে‌ ।…. ত্রিধা‌ বদ্ধো‌ মন্ত্রব্রাহ্মণকল্পৈ‌.. মহান্‌ দেবো‌ য়দ্যজ্ঞঃ ( নিরুক্ত‌. ১৩/৭ ) । গোপথ‌ ব্রাহ্মণেও‌ এমন ব্যাখ্যান‌ উপলব্ধ ।
২. মহাভাষ্য‌ পস্পশাহ্নিক – চত্বারি‌ শৃঙ্গা‌ চত্বারি‌ পদজাতানি‌ দ্বেশীর্ষে‌ দ্বৌ‌ শব্দাত্মানৌ‌ নিত্যঃ কার্য়শ্চ‌… সপ্ত‌ বিভক্তয়ঃ.. মহান‌্‌ দেবঃ শব্দঃ‌ ।
৩. বৌধায়নগৃহ্যসূত্র‌ ৩/১৯/২ – ….. অগ্নিমুপসমাধায়‌ সম্পরিস্তীর্য়‌ অগ্নিমুখাৎ‌ কৃত্বা‌ পক্বাঞ্জুহোতি‌ ইতি‌ পুরোনঙবাক্যামনুচ্য‌ … ।
৪. বৈখানস‌শ্রৌতসূত্র‌ – চত্বারিশৃঙ্গেতি‌ তিসৃভিস্তিস্রঃ শমীময়ীর্ঘৃতাক্তা সপ্রিধঃ ।। অগ্ন্যাধেয় প্রকরণের সমিদাধা‌নে বিনিয়ুক্ত ।
৫. তৈ‌. আরণ্যক‌. ১০/১০/২ ( পুনা‌ সংস্করণ ) –
চত্বারি‌ শৃঙ্গা….শৃঙ্গা প্রণবস্য‌ য়ান্য‌কারাবীনি‌ দেবঃ পরমেশ্বরঃ মর্ত্যান্‌ মনুষ্যদেহান্‌ আবিশেশ‌ সর্বতঃ প্রবিষ্টঃ স‌ এব‌ ইহ‌ আনখাপ্রেম্যঃ ।
এটা এই মন্ত্রের‌ পরমেশ্বরপরক‌ ব্যাখ্যান । এর বিনিয়োগ‌ উপাসনা প্রকরণে প্রযোজ্য ।
৬. ঋকসর্বানুক্রমণী‌ –
ক. সৌয়ঁ বাপং‌ বা‌ গব্যং‌ ঘৃতস্তুতির্বা‌ । ঘৃতস্তুতি দেবতার‌ উল্লেখ রয়েছে । অতঃ এই মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক‌ ঘৃতস্তুতির‌ও বিধান রয়েছে ।
খ. বৃহদ্দেবতা –
আদিত্যং‌ বা‌ ব্রাহ্মণোক্তং‌ প্রদিষ্টম্‌ অপাং‌ স্তুতিং‌ য়দি‌ বা ঘৃতস্তুতিং‌ । এখানে‌ও ঘৃত‌ বা জলের‌ স্তুতি দেবতা‌ বলা হয়েছে, অতঃ দুটির‌ই স্তুতি করা আবশ্য‌ক ।
৭. সায়ণকৃত‌ ঋগ্বেদ‌ ভাষ্যে‌ আশ্বলায়ন‌শ্রৌতসূত্র‌ ৮/৬ তথা‌ ৮/৯ নং সূত্রদ্বয়য়ের‌ আধারে‌ " ব্যুঢ়ে‌ দশরাত্রে‌ সপ্তমে‌ অহনীদমেব‌ সূক্তমাজ্যম্‌ " বর্ণিত হয়েছে ।
এই মন্ত্রের‌ পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে‌, গৃহ্য‌ এবং শ্রৌতসূত্রে‌ ভিন্ন‌-ভিন্ন‌ বিনিয়োগ পদ্ধতি উপলব্ধ । নিরুক্ত‌ এবং মহাভাষ্যেও ভিন্ন-ভিন্ন‌ দেবতা‌ এবং বিনিয়োগ উপলব্ধ । সর্বানুক্রমণী‌ এবং বৃহদ্দেবতা‌য়‌ও পরস্পর‌ কিছু ভেদ‌ বিদ্যমান । তৈত্তিরীয় আরণ্যকে‌ এই মন্ত্রের‌ পরমেশ্বরের উপাসনা বোধক বিনিয়োগ বিদ্যমান ।
৮. কুমারিলভট্টকৃত তন্ত্রবার্তিক –
চত্বারিশৃঙ্গেতি‌ রূপকদ্বারেণ‌ য়াগস্তুতিঃ । কার্য়কাল‌ উৎসাহং‌ করোতি‌ । হৌত্রে‌ ত্বয়ং‌ বিপুবতি‌ হোতুরাজ্যে‌ বিনিয়ুক্তঃ । তস্য‌ চাগ্নেয়ত্বাদহ্নশ্চাদিত্যদৈবতত্বসং‌স্তবাদাদিত্যরূপেণাগ্নিস্তুতিরূপং‌ বর্ণ্যতে । তত্র‌ চত্বারি‌ শৃঙ্গেতি‌ দিক্‌সয়ামানাং‌ গ্রহণম্‌ । ত্রয়ো‌ অস্য‌ পাদা‌ ইতি‌ শীতোষ্ণবর্ষকালাঃ ।।

শন্নো দেবী ( ঋগ্বেদ‌. ১০/১০/৪ ) এর বিনিয়োগ

১. সায়ণকৃত‌ ঋগ্বেদভাষ্য‌ – গতঃ সূক্তবিনিয়োগঃ ।
২. সায়ণকৃত অথর্ববেদভাষ্য‌ ( ১/৬/১ ) – " আপো‌ হি‌ ষ্ঠা‌ " ইতি‌ সূ্ক্তবৎ‌ সর্বত্র‌ বিনিয়োগোऽনুসন্ধেয়ঃ ।
৩. তৈ‌. ব্রাহ্মণ‌. ১/২/১/১ - ভট্টভাস্কর‌ কৃত ভাষ্য‌ – " অদ্ভিরবোক্ষসি‌ শন্নোদেবীরিতি গায়ত্র্যা‌ ।
৪. তৈ. ব্রা‌হ্মণ‌. ২/৫/৮/৫ প্রবর্গ্যস্যাভিষবপ্রকরণে‌ ।
৫. তৈ‌. আরণ্যক‌ ৪/৪২/৪ উপাসনাপ্রকরণে‌ এব‌ ।
৬. কৌশিকগৃহ্যসূত্রে ৯/৭ । শান্ত্যুদকপ্রারম্ভে সমাপ্তৌ‌ চ‌ শন্নো‌ দেবী সাবিত্রী‌ চ‌ প্রয়োক্তব্যা‌ ইত্যথর্বপদ্ধতিঃ ।
৭. আপস্তম্বশ্রৌতসূত্র‌ ৫/৪/১ – শন্নো‌ দেবী‌… ইত্যদ্ভিরবোক্ষ্য‌ তস্মিন্নুদীচীনবংশং‌ শরণং‌ করোতি‌ ।
৮. লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্র. ৫/৩/১৩ –
ক. শন্নো‌ দেবীরিত্যপ‌ উপস্পৃশ্যানপেক্ষং‌ প্রত্যাব্রজেয়ুঃ ।
খ. টীকাকরোऽগ্নিস্বামী – " শন্নো‌ দেবীরিত্যেতয়র্চা অপ উপস্পৃষ্ট্‌বা মেন‌ পথা‌ গতাঃ তং‌ পন্থানমন‌পেক্ষং‌ প্রত্যাব্রজেয়ুঃ ।
৯. শাঙ্খায়ন‌ শ্রৌতসূত্র‌ ৪/২১/১৯ – " শন্নো‌ দেবীরভিষ্টয়‌ ইত্যাদিকাভিশ্চতসৃভির্ঋগ্ভিরুরঃস্থলমভিমৃশেৎ‌ ।
১০. হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ১/৫/৭ – শন্নো‌ দেবী‌.. স্রবন্তু‌ নঃ ইতি‌ মার্জয়েৎ‌ ব্রহ্মচার্য়ুপনয়নে‌ ইতি ।
এই সব স্থলে‌ জল‌ দ্বারা স্পর্শ মার্জনাদির সামান্য‌ বিধান রয়েছে ।পরন্তু এই মন্ত্র ভিন্ন-ভিন্ন প্রকরণে‌ বিনিয়ুক্ত‌ হয়েছে । এই মন্ত্রে বিনিয়োগ ভেদ উপলব্ধ তা স্পষ্ট প্রতীয়মান । তৈত্তিরীয় আরণ্যকে‌ উপাসনা পক্ষে বিনিয়োগ বর্ণনা বিদ্যমান । লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্রে বর্ণন হয়েছে, আচমন‌ পূর্বক যে‌ মার্গে‌ গমন‌ করা হবে, সেই মার্গেই ফিরে আসতে হবে । শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্রে বর্ণন‌ হয়েছে, বক্ষের উপর‌ জল‌ প্রোক্ষণে বিনিয়োগ । হিরণ্যকেশীতে‌ যজ্ঞোপবীত বিষয়ে । এই বিবিধ‌ বিনিয়োগ পরস্পর ভিন্ন‌ নয় ?

দধিক্রাব্ণো অকারিষম্‌ এর বিনিয়োগ

দধিক্রাব্ণো‌ অকারিষম্ ( ঋগ্বেদ‌. ৪/৩৯/৬ )
১. সায়ণকৃত ঋগ্বেদ ভাষ্য‌ – " সূক্তবিনিয়োগো‌ লৈঙ্গিকঃ "
২. সায়ণকৃত‌ অথর্ববেদ ভাষ্য‌ – "সোময়োগে‌ দধিক্রাব্ণ‌ হত্যস্যা‌ ঋচ‌ আগ্নীধ্রীয়ে‌ দধিভক্ষণে‌ বিনিয়োগঃ " ।
৩. মহীধর‌কৃত যজুভাষ্য‌ – মহিষীমুত্থাপ্য‌ পুরুষা‌ দধিকাব্ণ ইত্যাহুঃ ।
৪. আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র‌. ৬/১২/১২ ।।
ক. দধিক্রাব্ণো‌ অকারিষমিত্যাগ্নীধ্রীয়ে‌ দধিদ্রপ্সান্‌ ভক্ষয়ন্তি ।
খ. পবিত্রেষ্ট্যাऽনুবাক্যা – আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র‌. ২/১২/৫
৫. ভট্টভাস্কর কৃত তৈ.সংহিতা‌ ভাষ্য‌ –
ক‌.
" ত্রিহবিষ‌ উত্তমস্য‌ দধিক্রাব্ণে চরুমিত্যস্য‌ পুরোऽনুবাক্যা‌ দধিক্রাব্ণো‌ ইত্যনুষ্টুপ্‌ "
( ১/৫/১১/৪ )
খ. " সর্বে‌ সুরভিমতীমৃচং‌ জপন্তি দধিক্রাব্ণ ইত্যনুষ্টুভা‌ ।
৬. ক‌. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ‌. ৭/৩৩/১ –
" দধিক্রাব্ণো‌ অকারিষভিত্যেতয়র্চা‌ সস্বাহাকারস্যানুবষট্‌কৃতে‌..
খ. সায়ণভাষ্য‌ – " দধিক্রাব্ণ ইত্যাদিনা‌ দর্ভ‌ পরিধীনামন্তঃ প্রক্ষিপেৎ‌ ।
গ. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ. ৬/৩৬/৮ – " ইতি‌ দাধিকীং‌ শংসতি " ।
৭. শতপথ ব্রাহ্মণ. ১৩/২/৯/৯
দধিক্রাব্ণো‌ অকারিষমিতি‌ সুরভিমতীমৃচমন্ততোऽন্বাহুর্বাচমেব‌ পুনতে‌ । নৈভ্যঃ প্রাণা‌ অপক্রামন্তি ।
৮. তৈ. ব্রাহ্মণ‌. ৩/৯/৭/৫ " দধিক্রাব্ণো‌ অকারিষমিতি‌ সুরভিমতীমৃচং‌ বদন্তি । " সুরভীন্‌ প্রাণান্‌ আত্মনি‌ স্থাপয়ন্তি ।
৯. গোপন ব্রাহ্মণ. ২/৬/১৬ – " অথ‌ দাধিক্রীং‌ শংসতি‌ দধিক্রাব্ণো‌ অকারিষমিতি ।
১০. পঞ্চবিংশব্রাহ্মণ‌. ১/৬/১৭ –
" দধিক্রাবন্‌ এর স্তুতি আমি করেছি । যা‌ বিজয়ী‌ এবং তীব্র গতিবিশিষ্ট‌ অশ্ব । তা‌ আমাদের‌ মুখকে সুরভিগন্ধ‌ দ্বারা যুক্ত‌ করে এবং আমাদের সুখ বৃদ্ধি করে ।
১১. লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্র‌ ২/৭/১০ –
ক. মাধ্যন্দিনেন স্তুত্বা সত্রেষু‌ দধিঘর্মস্য‌ ভক্ষয়েয়ুঃ সমুপহুয় দধিক্রাব্ণ‌ ইতি ।
খ. অগ্নীস্বামীর‌ টীকা‌ – " মাধ্যন্দিনেন‌ পবমানেন স্তুত্বা সত্রেষু‌ দধিদেশস্যৈকদেশং ভক্ষয়েয়ুঃ সর্বে‌ সমুপহুয় দধিক্রাব্ণ ইত্যেতয়র্চা‌ ।
১২. লাট্যায়ন শ্রৌতসূত্র‌. ২/১১/২৩ –
ক‌. আগ্নীধ্রীয়ং‌ গত্বা‌ দধিভক্ষং‌ ভক্ষয়েয়ুঃ । অসমুপহূয়‌ দধিক্রাব্ণ ইতি ।
খ. অগ্নিস্বামী কৃত টীকা‌ –
আগ্নীধ্রীয়ং‌ পরিশ্রিতং‌ গত্বা‌ দধিভক্ষং ভক্ষয়েয়ুঃ । অসমুপহূয়…সমুপহ্বানপূর্বকাঃ । তস্য‌ প্রতিষেধঃ…. ।
১৩. শাঙ্খায়ন‌ শ্রৌতসূত্র‌. ১২/২৫/১ এর ভাষ্য‌ –
আহননস্যানন্তরং‌ দধিক্রাব্ণোऽকারিষমিত্যেকাং‌ শংসেৎ‌ ।
১৪. কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র. ১০/৮/৯ –
দধগক্রাব্ণ‌ ইত্যাগ্নীধ্রে দধিভক্ষণম্‌ ।
১৫. গোভিল গৃহ্যসূত্র‌. ২/৬/১৬ –
দধ্নঃ প্রাশ্নন্তি দধিক্রাণ্বো‌ऽকারিষমিতি ।
১৬. শাঙ্খায়ন গৃহ্যসূত্র‌ —
ক‌. দধিক্রাব্ণোऽকারিষমিতি‌ জনি সম্পিবেয়াতাম্ ইতি । ( ১/১৭/১ )
খ. হুতশেষাদ্ধবিঃ প্রাশ্নন্তি দধিক্রাব্ণোऽকারিষমিত্যেতয়া । ( ৪/৫/১০ )
১৭. পারস্কর গৃহ্যসূত্র‌. ১/১০/১৬
দধিক্রাব্ণো ইতি জনি ভক্ষয়েয়ুঃ ।
লক্ষ্যণীয় বিষয়, পারস্কর গৃহ্য‌সূত্রে‌র উপাকর্ম বিধিতে‌ দধিভক্ষণ‌ বিনিয়োগ বর্ণন হয়েছে ।
নিঃসন্দেহে এই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ শ্রৌত‌ এবং গৃহ্যসূত্রে‌ দধিভক্ষণ‌ আদিতে‌ বর্ণন করা হয়েছে, পরন্তু মন্ত্রে উল্লেখিত দধিক্রাবন্‌ এর অর্থ হলো অশ্ব‌, জনি নয় । এই মন্ত্রের বিনিয়োগ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে‌, দধিভক্ষণ হ‌ওয়ার হলেও ভিন্ন-ভিন্ন‌ ক্রিয়ায় দধিভক্ষণ‌ আদিতে বিনিয়ুক্ত‌ বিদ্যমান । আশ্চর্যের বিষয় হলো, অশ্বমেধ‌ প্রকরণেও দধিভক্ষণের বিনিয়োগ পদ্ধতি বর্ণিত রয়েছে । সমস্ত শ্রৌত এবং গৃহ্যসূত্রে এই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ পদ্ধতি‌ সমগ্র‌ ব্রাহ্মণ শাস্ত্র‌ এবং নিরুক্তে প্রদর্শিত সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ নির্দেশ করছে ।
এই প্রকার পরস্পর বিরুদ্ধ বর্ণনা দ্বারা শ্রৌত আদি গ্রন্থের কর্তার‌ প্রতি অনাস্থা তৈরি হয় ।

গৃহ্যসূত্র‌ এবং বিনিয়োগ

শ্রৌতসূত্র‌ থাকার‌ পর‌ও গৃহ্যসূত্রের‌ আবশ্যকতা কেনো হলো‌ তা এক পৃথক্‌ বিচারণীয়‌ বিষয় । এটা বলা যায়‌ যে‌, যখন‌ শ্রৌতে সর্বসাধারণের অনুমতি ছিলো না‌ বা শিথিলতা হতে থাকে‌, তখন‌ গর্ভাধান থেকে শুরু করৈ মৃতকসংস্কার‌ পর্যন্ত‌ সমগ্র‌ সংস্কারাদি‌ সর্বসাধারণে‌র মাঝে বেদের সঞ্চার হতে থাকে । অথবা‌ এমন‌ও হতে পারে যে‌, প্রারম্ভকাল‌ থেকেই মন্ত্র দ্বারা নামকরণাদি সংস্কার বিদ্যমান ছিলো । এসবের‌ মূল‌ তো বেদ‌ই, কিন্তু ব্যাখ্যান রূপে গ্রন্থ পরবর্তীতে রচিত হয়েছে । এটা অধিক‌ মান্য‌ যোগ্য‌ । গৃহ্যসূত্র‌ শ্রৌতসূত্রের‌ পরবর্তীতে রচিত‌ হয়েছে । গৃহ্যসূত্রে উপলব্ধ বিনিয়োগ পদ্ধতি পরস্পর‌ ভিন্ন‌ । কিছু প্রমাণ দর্শানো হলো —
গায়ত্রী মন্ত্র সম্বন্ধে‌ গৃহ্যসূত্রে‌ উপলব্ধ পরস্পর বিরোধী বিনিয়োগ পদ্ধতি –
১. " তৎ‌সবিতুর্বরেণ্যম্‌ " এই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ পদ্ধতি বৌধায়ন গৃহ্যসূত্রে –
ক‌. তৎসবিতর্বরেণ্যম্‌ ইত্যেতাং‌ পচ্ছোऽর্ধর্চশস্ততঃ সমস্তাম্‌ ।
এখানে বর্ণিত হয়েছে যজ্ঞোপবীত‌ সংস্কারে‌ ব্রহ্মচারীদের‌ গায়ত্রী মন্ত্রের‌ উপদেশ প্রদানের‌ বিনিয়ুক্ত‌ ।
খ‌. অপরেণাগ্নিমুভৌ‌ জায়াপতী‌ প্রাদনীয়াতাম্‌ – " তৎ‌ সবিতুর্বরেণ্যম্‌ "
গ‌. তৎসবিতুর্বরেণ্যম্‌ ইতি‌ সদ্যঃ পাত্রমাদায়‌ ব্রহ্মপাত্রেণ‌ য়োজয়েৎ‌ ।
২. কৌষীতকীগৃহ্যসূত্র‌. ১/৩/৮ –
তৎসবিতুর্বরেণ্যম্‌ ইত্যেতাং‌ সপ্রণবাম্‌ অর্ধর্চশোऽনবানম্‌ ।
দ্বাভ্যামঙগুলিভ্যাং‌ প্রদক্ষিণমাচাল্যানামিকয়াঙগুল্যাঙগুষ্ঠেন‌ চ‌ সং‌গৃহ্য‌ প্রাশ্নাতি । ওম ভূস্ততসবিতুর্বরেণ্যম্ ।
বিবাহ প্রকরণের প্রাশনে‌র পক্ষে বিনিয়ুক্ত ।
৩. আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্র‌. ৮/১
বৈশ্বদেবে‌ শস্ত্রে‌ প্রতিপত্তৃচস্যৈতে‌ এব‌ প্রথমদ্বিতীয়ে‌ । তৎসবিতুর্বরেণ্যম্‌ ইতি‌ দ্বে‌ আ‌ বিশ্বদেবম্‌ । আশ্বলায়ন‌ শ্রৌতসূত্র‌. ৭/৬
উপরে কৌশিক গৃহ্যসূত্রে‌ বর্ণিত‌ বিনিয়োগ‌ পদ্ধতি‌ অন্য‌ সব গৃহ্যসূত্রে বর্ণিত যজ্ঞোপবীতের‌ পক্ষে বিনিয়োগ পদ্ধতির সাপেক্ষে তা পুরোপুরি ভিন্ন এবং পরস্পর বিরোধী । আশ্বলায়ন শ্রৌতসূত্রের বিনিয়োগ পদ্ধতি গৃহ্যসূত্র‌ থেকে স্পষ্ট ভেদ লক্ষ্যণীয় ।

বেদ ভাষ্যকার এবং বিনিয়োগ

ইতিহাসে বিভিন্ন ভাষ্যকার‌ তাদের স্ব মতের সাপেক্ষে বিবিধ‌ শ্রৌতসূত্রের‌ আধারে‌ বিনিয়োগ দর্শিয়েছে । শ্রৌত সূত্রের‌ বিষয়ে‌ উপরে‌ যা‌ বর্ণনা করা হয়েছে তা‌‌ এই বেদ ভাষ্যকারগণের‌ ক্ষেত্রে‌ও প্রযোজ্য । পরন্তু এখানে আর‌ও কিছু বিষয় বিচার্য‌ বটে‌ ।
১. সায়ণ তার‌ ঋগ্বেদ ভাষ্যে‌ প্রায়ঃ সব মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ দর্শানোর‌ চেষ্টা করেছে, সে‌ এটাই মেনেছে যে‌, প্রতিটি মন্ত্রে‌র‌ বিনিয়োগ আবশ্যক, যদি‌ কোনো মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ ব্রাহ্মণ‌ বা শ্রৌতে উপলব্ধ না থাকে‌ তবু‌ও সেই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ করতে হবে ।
এ কারণে‌ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হ‌ওয়া যায় যে‌, আশ্বলায়নাদি শ্রৌতসূত্রকারগণ সম্পূর্ণ ঋগ্বেদকে চতুর্থাংশেরই বিনিয়োগ করে থাকবেন, অবশিষ্ট তিন চতুর্থাংশ ঋগ্বেদের বিনিয়োগ তো নেই। যা আছে, সেটি কল্পিত। এ বিষয়ে সায়ণকৃত‌ ঋগ্বেদভাষ্য‌ দ্রষ্টব্য‌ । ভাষ্যের‌ প্রথম মণ্ডলের‌ ৪৮টি সূক্তের‌ বিনিয়োগ " লৈঙ্গিক‌ " বা‌ স্মার্ত্ত নামে উল্লেখ রয়েছে । ১৫, ১৮, ২০, ৪২ নং সূক্তে‌ " বিনিয়োগস্তু‌ স্মার্ত্তো‌ দ্রষ্টব্যঃ " এমনটা উল্লেখ রয়েছে । ১, ২২, ৩৮, ৪০ নং সূক্তে‌ " সূক্তবিনিয়োগো‌ লৈঙ্গিক‌ঃ " উল্লেখ । ১ম মণ্ডলের‌ ৬২ নং সূক্তে " গতঃ সামান্যবিনিয়োগঃ " " বিশেষবিনিয়োগস্তু লিঙ্গাদবগন্তব্যঃ " । ১ম মণ্ডলের‌ ৯২ তম সূক্তে‌ আশ্বিন‌ শস্ত্র‌ পক্ষে বিনিয়োগ বিদ্যমান এবং এই সূক্ত অগ্নি দেবতা বিশিষ্ট । পরন্তু‌ ৯ম মণ্ডলের‌ ১৮ নং‌ সূক্তের‌ বিনিয়োগ‌ সায়ণভাষ্যে‌‌ও অনুপলব্ধ ।
দুর্গাচার্য‌ তাঁর নিরুক্তটীকা‌য় " অগ্নিমীডে‌ " এই মন্ত্রের‌ বিষয়ে " আশ্বিনে‌ বিনিয়োগঃ " লিখেছেন । বিচার্য‌ বিষয় এই যে, অশ্বিদেবতা বিশিষ্ট কর্মে‌ অগ্নি‌ দেবতা বিশিষ্ট মন্ত্র কেমনভাবে বিনিয়ুক্ত‌ সম্ভব ?

কাল্পনিক বিনিয়োগের‌ নির্বোধতা

উপরে‌ বিস্তারিত ভাবে দর্শানো হয়েছে যে‌, ব্রাহ্মণ-শ্রৌত-গৃহ্যাদি‌ গ্রন্থে‌ " দধিক্রাব্ণো‌ অকারিষম্‌ মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ দধিভক্ষণাদি ক্রিয়ায় প্রযুক্ত‌ হয়, পরন্ত‌ মন্ত্রে‌র " দধিক্রাবন্‌ " পদ‌ অশ্ববাচী‌ । দধি‌র‌ সাথে এই মন্ত্রের‌ পদ‌সমূহ এবং এই পদসমূহের অর্থের‌ কোনোরূপ সম্বন্ধ নাই ।
সংস্কাররত্নমালা‌ গ্রন্থে‌ ( পুনা‌ থেকে প্রকাশিত ) —
১. জাতবেদসে‌ সুনবাম‌ সোমমরাতীয়তো‌ নিদহাতি‌ বেদঃ ।
স‌ নঃ পর্ষদতি‌ দুর্গাণি‌ বিশ্বা‌ নাবেব সিন্ধু‌ দুরিতাত্যগ্নিঃ ।। [ ঋগ্বেদ‌. ১/৯৯/১ )
এই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ সংস্কাররত্নমালা‌র প্রণয়ন‌ কর্ত্তা বর্ণনা করেন‌, " দুর্গাপ্রোত্যর্থ‌ বলিদানে‌ বিনিয়োগঃ " ; " দুর্গাবাহনে‌ বিনিয়োগঃ " । অর্থাৎ দুর্গা‌'র প্রসন্ন হেতু বলিদান‌ করার সময় এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে । যা‌ গ্রন্থকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব কপোলকল্পিত‌, ভিত্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা‌ । সমগ্র বেদে‌ দুর্গা‌ নামটি পর্যন্ত নাই ।
মন্ত্রে‌ প্রযুক্ত‌ ‌ " দুর্গাণি‌ " শব্দের অর্থ সায়ণ‌ পর্যন্ত করেছে‌, " বিশ্বা বিশ্বানি‌ সর্বাণি‌ দুর্গাণি‌ দু্র্গমনানি‌ ভোক্তুভাবশ্যকানি‌ দুঃখানি‌ " । দুঃখের‌ দূরীভূত করার‌ জন্য‌ প্রার্থনা করা হয়েছে । দুর্গাণি‌র‌ অর্থ‌ দুর্গম‌ স্থিতি‌ ।
২. " শন্নো‌ দেবীরভিষ্টয়ে‌ " মন্ত্রের‌ বিষয়ে‌ মন্ত্রার্থচন্দ্রোদয়‌ গ্রন্থে‌ লিখিত হয়েছে –
'শনির্দেবতা, শনিপূজনে, তৎপ্রীত্যর্থং তদীয়জপহোমাদৌ চ বিনিয়ুক্তঃ ।'
শন্নো দেবীর শনৈশ্চরের সাথে কোনো সম্বন্ধ কখনো হতে পারে ?
এই মন্ত্রের ব্রাহ্মণ শ্রৌত- গৃহ্যের প্রায় সব বিনিয়োগের অর্থ পূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।এই মন্ত্রের সব ভাষ্যকারের বিনিয়োগ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে ।
তারা কেউ কি ' শন্নো দেবী ' এর অর্থ বুঝতে পারেননি ? কেননা ইনাদের ঐ বিষয় মাথায় আসেনি মন্ত্রার্থচন্দ্রোদয়ে বর্ণিত বিনিয়োগ ব্যাখাকারীর মাথায় যা এসেছে !!! বাহ্ মহারাজ !
এই ' শন্নো দেবী'এবং শনৈশ্চরের ভেতর কি সম্বন্ধ রয়েছে ? নিকটের না হোক তবে দূরেরই কিছু,তো বলে দিতে পারতেন । এই ধৃষ্টতারও কোনো ঠিকানা রয়েছে !
'কয়া নশ্চিত্রা'কে রাহুর আবাহনে সংস্কাররত্নমালার পৃষ্ঠা. ১৩৬ এ লাগিয়েছেন। শন্নো দেবী.' কে শনৈশ্চরের বাহনে পৃ. ১৩৬ এ, 'অগ্নি দূতং' কে অগ্নিপূজনে পৃ. ১৪২তে, 'তৎসবিতুর্বরেণ্যম্' কে 'গো- মূত্রপ্রক্ষেপে বিনিয়োগঃ' পৃ. ১৪৬ এ লাগিয়েছেন, 'আগো' কে সর্পের আবাহনে পৃষ্ঠা. ১৪৩, 'হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ততা' কে 'ওষধিনিবপনে বিনিয়োগ:' পৃষ্ঠা. ১১৩ ।
শুধুই এই নয়, পাগড়ী পড়ায় এবং দন্তধাবনেও মন্ত্রের বিনিয়োগ বলেছেন। মন্ত্রার্থ চন্দ্রোদয় পৃ. ১৩ তে - 'ধূরসি ধূর্ব-দেবহূতমম্' ধূপনিবেদনে বিনিয়োগঃ । অর্থাৎ এই মন্ত্রের দ্বারা ধূপ জ্বালিয়ে পূজা করা। পৃ.২৯৪ এ - ' য়ুবা সুবাসা. ' এই মন্ত্রকে পাগড়ী পড়ার সাপেক্ষে বিনিযুক্ত করা হয়েছে ।
বর্তমানে কুসংস্কারী তথাকথিত বিনিয়োগ কারীদের‌ স্বরূপ এই-ই । যার‌ ফলে বেদে‌ অনাস্থার‌ উৎপন্ন হয় ।

বিনিয়োগ বিষয়ে‌ বৈদিক সিদ্ধান্ত

বিদিত‌ যে‌‌, ঋগ্বেদের‌ প্রথম মন্ত্র‌ " অগ্নিমীডে‌ পুরোহিতম্‌ " এর বিনিয়োগ‌ ঋকসর্বানুক্রমণী এবং বৃহদ্দেবতায়‌ অনুপলব্ধ । স্কন্দ স্বামী‌ও তাঁর ঋগ্বেদ ভাষ্য এবং নিরুক্তটীকা‌য়‌ উক্ত মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ বিষয়ে কোনো বর্ণনা করেন নাই । তিনি তাঁর ঋগ্বেদ ভাষ্য‌ এবং নিরুক্তটীকায়‌ কোনো মন্ত্রের‌ কোনোরূপ বিনিয়োগ পদ্ধতি বর্ণনা করেন নাই ‌ । বেঙ্কটভাষ্যেও‌ বিনিয়োগের চিহ্ন‌ নাই । তবে‌ দুর্গাচার্য‌ তাঁর নিরুক্ত টীকায়‌ প্রায়ঃ সব মন্ত্রের‌‌ই বিনিয়োগ শ্রৌতসূত্রের‌ আধারে‌ দর্শিয়েছেন‌ । ঋগ্বেদের‌ প্রথম মন্ত্রের বিনিয়োগ‌ " আশ্বিনে‌ বিনিয়োগঃ " এমনটা বর্ণন হয়েছে । পরন্তু এই মন্ত্রের দেবতা অগ্নি‌ এবং সমগ্র‌ শ্রৌত-গৃহ্য‌ আদি‌ গ্রন্থে‌ অগ্নি দেবতা বিশিষ্ট যজ্ঞাদি‌ কর্মে‌‌ই এই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ বর্ণন উপলব্ধ । আশ্বিন‌ ( অশ্বিনৌ‌ দেবতা বিশিষ্ট ) কর্মে‌ অগ্নি‌ দেবতা বিশিষ্ট এই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ কদাপি‌ অসম্ভব ।
আমাদের কথা হচ্ছে যে সায়ণ বা তদনুবর্তী অনুসারীগণ‌ বিনিয়োগের এই অর্থ বুঝে নিয়েছে যে, মন্ত্র সমূহের অন্য বিনিয়োগ হতেই পারে না,যা তাদের সর্বথা কপোলকল্পিত অবৈদিক ধারণা‌, মৌলিক ভুল। মূল মন্তব্য‌ এই যে‌, যেমন মন্ত্রের দেবতা সর্বানুক্রমণী আদি থেকে ভিন্ন‌‌ ,এই প্রকারে বেদমন্ত্রের বিনিয়োগও বিনিয়োগকারীর অধীন । যদি মন্ত্রের অর্থ উক্ত ক্রিয়ার সাথে সঙ্গত হতে পারে তাহলে ঐ মন্ত্রের বিনিয়োগও উক্ত ক্রিয়াতে অবশ্যই হবে। বিনিয়োগের অনেক ঊঁচু ও দৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে অবৈদিক সায়ণাদি বেদার্থের খুব সংকুচিত ও দারিদ্র্যপূর্ণ অবস্থা করেছে। যদি তা কিঞ্চিত‌ও স্বীকার করা হয় তবে বেদের সম্বন্ধে উৎকৃষ্ট পবিত্র ভাবনা বা প্রাচীন পূজাভাব বা এর পবিত্র প্রামাণিকতার,এর দিব্য খ্যাতির অবুদ্ধিপূর্ণতার‌ প্রদর্শন করে এবং বেদের প্রতি অনাস্থার জন্ম দেয়।
এটিই এই বিষয়ে প্রধান মন্তব্য ।
য়ৎ‌ কর্ম‌ ক্রিয়মাণমৃগ্‌য়জুর্বাऽভিবদতি‌ ।
যে‌ কর্মের সাপেক্ষে মন্ত্রের পদসমূহের অর্থ‌ নির্দেশ করে‌ অর্থাৎ, মন্ত্র‌ যে‌ প্রকৃত অর্থ প্রকাশ করে বা‌ মন্ত্রের‌ অর্থ‌ যে‌ কর্মের সাপেক্ষে দর্শায়িত করে‌, তাতেই সেই মন্ত্রের‌ বিনিয়োগ আবশ্যক ।
যে‌ পর্যন্ত‌ এই সিদ্ধান্তের চর্চা‌ তথা প্রচলন‌ ছিলো‌ ততক্ষণ‌ পর্যন্ত‌ বিনিয়োগের স্বরূপ সঠিক ছিলো । ব্রাহ্মণ কালের পূর্ব সময়কাল পর্যন্ত‌ এই স্বরূপ‌ই বিদ্যমান ছিলো । এ কারণে। মহর্ষি দয়ানন্দ‌ জী আমাদের ব্রাহ্মণকালের‌ পূর্বকালে নিয়ে গিয়েছেন‌ । যেমন ব্রাহ্মণ গ্রন্থের‌ পশুযাগ‌ আদি‌কে মহর্ষি দয়ানন্দ‌ জী বেদ বিরুদ্ধ হ‌ওয়ায়‌ তা সম্পূর্ণ অপ্রামাণিক মেনেছেন এবং নিগূঢ়ভাবে খণ্ডন করেছেন । ব্রাহ্মণ গ্রন্থের সাথে শ্রৌত সূত্র‌, গৃহ্যসূত্র‌ আদি গ্রন্থে উপলব্ধ নির্দিষ্ট বিনিয়োগ‌ও ( বেদ বিরুদ্ধ সমস্ত বিনিয়োগ ) বেদ বিরুদ্ধ হ‌ওয়ার দরূণ তা কদাপি মান্য‌ হয় এবং সর্বথা অপ্রামাণিক ।
মহর্ষি দয়ানন্দ‌ জী এইসব মিথ্যা জ্ঞানরূপী গুহা‌ থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন এবং চিরন্তন, চির শাশ্বত সত্যের‌ পথে এনেছেন । এ কারণে‌ আমরা‌ আমাদের প্রাণপ্রিয় ঋষি দয়ানন্দকে মানি এবং তাঁর জয়ধ্বনি করি