https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

ওঙ্কারোপাসনা এবং মূর্তি আদি প্রতীকের উপাসনা

Tuesday, August 1, 2023


মূর্তিপূজা আর ওঙ্কারোপাসনা দুটো বিষয় কখনো সমান হতে পারে না। বেদে কোথাও মূর্তিপূজার বিধান নেই। মূর্তিপূজা তো বহুকাল পরে প্রচলিত হয়েছে। আজকাল যে যে প্রতীক বা মূর্তির পূজা করা হয়, সেগুলো অনেক আধুনিক কালের। ত্রিদেবের বর্ণনায় এগুলো বিস্তারিতভাবে লিখব, এখানে এতটুকুই জেনে রাখুন যে, ঋষিদের সিদ্ধান্ত বেদানুকূল। প্রসিদ্ধ উপনিষদগুলো বেদতত্ত্ববিৎ ঋষি প্রণীত। এজন্য উপনিষদে বেদবিরুদ্ধ চর্চা নেই। এখন এই বিবাদকে ত্যাগ করে এ কথা বিচার করুন যে, যেভাবে প্রতিমায় ধ্যান হয়, সেভাবেই কি ওঙ্কারে ধ্যান করার তাৎপর্য হতে পারে ? এমন কখনো হতে পারে না, কেননা ওঙ্কার একটি শব্দ, শব্দের আর রূপ কী হবে! যদি বলেন, “যেভাবে আজকাল ‘ওম্’ শব্দকে লেখা হয়, সেরকমই এর আকার। আর সেই আকারকে ব্রহ্ম মেনে ধ্যান করতে হবে।” শুনুন! এতেও অনেক বড় বাধা সৃষ্টি হবে, কেননা যত প্রকারের লিপিসমূহ (বর্ণমালা) দেশে প্রচলিত রয়েছে, ঠিক তত প্রকারের ধ্যান হয়ে যাবে। ভারতবর্ষেই মুখ্য ও গৌণ ভেদে পঞ্চাশটি লিপির সন্ধান পাওয়া যায়, তত সংখ্যক উপায়ে “ওম্” শব্দ লিখা যাবে। আর তখন আপনার কথা অনুসারে তত প্রকারের ধ্যান হয়ে যাবে। 
 
যদি বলেন যে, “এটিই আমাদের ইষ্ট, কেননা ভগবানের অনন্ত রূপ আছে, তাই অনন্ত প্রকারে তাঁর ধ্যান হবে, যেভাবে অনন্ত প্রকারের প্রতিমাতে তৎসদৃশ ধ্যান হয়। এতে কি এমন ক্ষতি হবে?” শুনুন, যদি উপনিষৎকার ঋষিগণের এরকম অভিপ্রায় হতো, তবে কমপক্ষে লিপির আকারের অনুকূল দুই-চারটি আকারের ধ্যানস্বরূপ অবশ্যই বলে যেতেন; কিন্তু তা বলেননি। এর থেকে বুঝা যায় যে, উপনিষদের তাৎপর্য আপনার কথার বিরুদ্ধ। সম্পূর্ণ উত্তর মীমাংসা যা ‘বেদান্তদর্শন’ নামে প্রসিদ্ধ, তাতে লক্ষ্য করুন। কখনো পরস্পর বিরোধী একাধিক গুণ বিষয়ে বলা হয়নি, আর না ব্রহ্মের কোনো আকার উপদিষ্ট হয়েছে। এমনকি উপনিষদেও ওঙ্কারেরও কোনো রূপ বর্ণিত হয়নি। এজন্য আপনার কথাটি শাস্ত্র বিরুদ্ধ। আর দ্বিতীয় কথা এই যে, অক্ষরের কোনো আকার হয় না। কিন্তু বালকদের বোধের জন্য মনুষ্য বিবিধ লিপি কল্পিত করেছে। যদি লিপির অনুসারে ওঙ্কারের তত্তৎ রূপের ধ্যান করেন তবে আপনার ধ্যানও কল্পিত মাত্র হবে, এই কারণেও আপনার কথাটি ঠিক নয়। 
 
যদি বলেন, “যেভাবে কল্পিত অক্ষরের দ্বারা সত্য জ্ঞান প্রাপ্ত হয়, সেভাবেই কল্পিত আকারের দ্বারা সত্য ব্রহ্মকেও জানতে পারবে।” এই কথাও ঠিক নয়। দেখুন, অদৃশ্য বস্তুকে জানার জন্য শব্দ মধ্যস্থ (মাধ্যম) হয়, মূর্তি নয়। রামচন্দ্রের বর্ণনা শব্দের দ্বারা বাল্মীকি মুনি বলেছেন, মূর্তির দ্বারা নয়। যখন কেউ বাল্মীকিরামায়ণ অথবা তুলসীদাসকৃত রামায়ণের শব্দকে পাঠ করে তখন তার মন গদ্গদ্ (প্রসন্ন) হয়ে যায়। রামচন্দ্রের সম্পূর্ণ চরিত্র তার সামনে নৃত্য করতে শুরু করে। মানুষ শব্দকেই পড়ে, আর সেটিই বিচার করে। এখানে এই কথাও স্মরণে রাখবেন যে, শ্রী রামচন্দ্র ছিলেন অযোধ্যার মনুষ্য রাজা। তাঁর পিতা-মাতা, পুত্র, আত্মীয় সবাই সেখানে ছিলেন। এজন্য তাঁর প্রতিকৃতি কাগজের ওপর আঁকা যেতে পারে, প্রস্তর আদির ওপর তাঁর মূর্তি খোদাই করা যেতে পারে। তিনি যদি বর্তমান সময়ের মানুষ হতেন, তবে তাঁর চিত্রও (Photograph) থাকতো। 
 
এখন আপনি ক্ষণ মাত্র বিচার করুন, আপনি কখনো শ্রী রামকে শব্দের দ্বারা শোনেননি; আপনাকে কেউ এ কথা বলেনি যে, শ্রী রামচন্দ্র অযোধ্যার রাজা ছিলেন ইত্যাদি। এমতাবস্থায় কোন প্রস্তর দ্বারা নির্মিত কৌশল্যা দেবীর কোলে বসা বালকরূপী রামচন্দ্রকে দেখেও আপনার কিছুই বোধ হবে না। এরপর আপনাকে বাণীর দ্বারা কাউকে জিজ্ঞাসা করতেই হবে যে ইনি কে। তারপর শব্দের দ্বারাই তার ভেদ বললে তবেই জ্ঞান হবে। এই কারণে মধ্যস্থ (মাধ্যম) হলো শব্দ, মূর্তি নয়। এখন পুনরায় লক্ষ্য করুন, যখন আপনাকে কেউ বললো যে, ইনি শ্রী রামচন্দ্র আর ইনি তাঁর মাতা কৌশল্যা দেবী, সেই সময় আপনার কীভাবে বোধ হলো? অক্ষরের রূপ ধ্যানের মাধ্যমে অথবা শব্দের বোধের মাধ্যমে? নিঃসন্দেহ শব্দের বোধ দ্বারাই আপনার পদার্থের জ্ঞান হয়েছে। সেই সময় এই অক্ষরের আকার কীরূপ, এর প্রতি কোনো মনোযোগ নেই। কিন্তু পদের অর্থের উপর মনোযোগ আছে। কোথাও কোথাও কথা (প্রবচন) বা ব্যাখ্যান হয়। তাহলে যে ব্যক্তি অশিক্ষিত, অক্ষর জ্ঞানহীন, কিন্তু যে ভাষায় কথা (প্রবচন) হচ্ছে তা শুনে বুঝতে পারে, তখন সে সম্পূর্ণ কথা সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়। অক্ষরের কোন আবশ্যকতাহয় না; পুস্তকে কেবল অক্ষরের আকারকে দেখার ফলে আপনার কি কিছু বোধ হয়? কোন কিছুই বোধ হয় না। যদি অক্ষরের আকার দেখার মাধ্যমে কারো বোধ হয়, তবে এক মহামূর্খেরও বোধ হওয়া উচিত, কেননা সে তো চক্ষু দ্বারা অক্ষরের আকারকে দেখছে— অক্ষর বাঁকা নাকি সোজা, ত্রিকোণ নাকি গোল ইত্যাদি। কিন্তু সেই অজ্ঞানী কোনো কিছুই জ্ঞাত হয় না। কেউ আজীবন অক্ষরের রূপ ধ্যান করতে থাকুক, কিন্তু এতে তার একটি শব্দেরও বোধ হবে না। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অক্ষর শব্দকে জানার জন্য একটি সংকেত মাত্র। 
 
কিন্তু শব্দই পদার্থ সম্পর্কে প্রাপ্ত জ্ঞানের মুখ্য কারণ। যদি শব্দ না থাকে, তবে আমরা কিছুই জানতে পারব না। পুস্তকে অক্ষর থাকে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বাণীর দ্বারা এ কথা না বলা হয়— এর নাম ‘’ এবং এর নাম ‘’, ততক্ষণ পর্যন্ত বোধ হবে না। দেখুন, অক্ষর কী পদার্থ? বালকেরা অক্ষর শেখে, ধীরে ধীরে তাদের সব অক্ষরের বোধ হয়ে যায়। কিন্তু ওই সব অক্ষরের দ্বারা কোনো পদের বোধ হয় না। যদি অক্ষরের দ্বারা পদের বোধ হতো, তবে তাদের সব পদের পদার্থেরও বোধ হয়ে যাওয়া উচিত; কিন্তু এরকম কখনো হয় না। এজন্য ‘অক্ষর’ বোধের কারণ নয়। এখন দেখুন, অক্ষর জানার পরও পদের অর্থ বলে দিতে হয়। এর দ্বারাও ওই পদ-সম্বন্ধী পদার্থের বোধ হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত মনুষ্য সেই পদার্থকে নিজের চোখে না দেখে অথবা অনুমান আদি প্রমাণের দ্বারা না জেনে নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো বস্তুর বোধ হয় না। এজন্য (আমাদের পদার্থ সম্পর্কিত) বোধের কারণ ‘অক্ষর’ নয়। একজন অন্ধ বালককে দেখুন, তাকে অক্ষর ব্যতীত কেবল পড়ানোর মাধ্যমেই তার সবকিছুর বোধ হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, চোখ ছাড়া রূপের বোধ হয় না। 
কিন্তু সে পড়ার কারণে সম্পূর্ণ রামায়ণ বলতে পারে, আর আপনি হয়তো দেখেছেনও, এমন ঘটনা অনেক হয়ে থাকে। মনে করুন, আপনি ইংরেজী অক্ষর জানেন না, আপনার সামনে কেউ ইংরেজী অক্ষরে কিছু লিখে রেখেছেন। আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, এই অক্ষরগুলো কেমন। মনে করুন, অক্ষর যেভাবে লিখতে হয়, সেভাবে লিখেও ফেলেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আপনাকে এ কথা কেউ বলে দেয়নি যে, এটি ‘A’ আর এটি ‘B’। এখন নিজেই বিচার করুন, অক্ষরের আকার (রূপ) সম্পর্কে বোধ হওয়ার পরও আপনার যথার্থভাবে A B C D এর বোধ হলো না। এজন্য ‘অক্ষর’ বোধের কারণ নয়। কোনো বস্তু সম্পর্কে যথার্থ বোধ কিছু শব্দের দ্বারাই হয়। কিন্তু যথার্থভাবে প্রত্যক্ষ অনুভবের দ্বারাই বস্তুর যথার্থ বোধ হয়। এর জন্য ঈশ্বর ভিন্ন-ভিন্ন ইন্দ্রিয় ভিন্ন-ভিন্ন বস্তুর জ্ঞান করার জন্য দিয়েছেন; আর সেগুলোর মাধ্যমেই (কোনো পদার্থ সম্বন্ধে) যথার্থ জ্ঞান হয়ে থাকে। যদি বলেন, “ওম্ শব্দের যেরূপ উচ্চারণ করা হয়, ওইরূপ উচ্চারণের ধ্যান করাই উপনিষদের তাৎপর্য।” তবে তাও ঠিক নয়, কেননা কণ্ঠস্বর ভেদে ওঙ্কারের উচ্চারণও অসংখ্য হবে, ফলে কোনো স্থিরতা থাকবে না। আর না শাস্ত্রে এরূপ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়। এবার লক্ষ্য করুন, উচ্চারণ বলা হয় ধ্বনিকে। সেই উচ্চারণ বা ধ্বনিই তো আর ঈশ্বর নয়। (ওঙ্কার ধ্বনিকেই ঈশ্বর বলে মনে করা) এসব অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা।

॥ ইত্যলম্ ॥
 
— পণ্ডিত শিবশঙ্কর শর্মা কাব্যতীর্থ