শুরুতেই মনসা দেবী সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক---
মনসা মূলত লৌকিক দেবতা(লোকমুখে যার দেবত্ব বেশি প্রতিষ্ঠিত)। সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে, সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশ্যে তাঁর পূজা করা হয়।
কিন্তু এই দেবীর উল্লেখ সনাতন ধর্মের কোন নির্ভরযোগ্য ধর্মগ্রন্থ তে পাওয়া যায় না। এই দেবীর উল্লেখ না আছে বেদ-উপনিষদ এ,না আছে রামায়ন-মহাভারত এ,এমনকি মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতেও নেইই।
তাহলে এই মনসা এলো কোথা থেকে?
হ্যাঁ,সর্বপ্রথম পুরাণ এ মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়। আর পুরাণগুলো হলো মানুষ এর রচিত।মনসা সম্বন্ধে তাই একেক পুরাণে একেক কথার উল্লেখ পাওয়া যায়।কোন পুরাণে আছে পৌরাণিক দেবতা শিব হলো মনসার পিতা আবার কোন জায়গায় আছে শিব নয়,ঋষি কশ্যপই হলো মনসার পিতা। মনসার সৎ-মা চণ্ডী (শিবের স্ত্রী পার্বতী) তাঁকে ঘৃণা করতেন। এই কারণে মনসা অত্যন্ত উগ্র স্বভাব ও অসুখী এক দেবী।
মনসা সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি তথ্য যে গ্রন্থ থেকে জানা যায়,তা হলো "মঙ্গলকাব্য".কিন্তু এটিও কোন ধর্মগ্রন্থ নয় সনাতন ধর্মের।
মঙ্গলকাব্য খ্রিস্টীয় ১৩শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে মনসা প্রমুখ দেবদেবীদের নিয়ে মঙ্গলকাব্য নামক এক শ্রেণির ভক্তিমূলক লৌকিক গাথাকাব্য। এখানে লেখক তার কল্পনারচিত ভাবে এসব দেব দেবীর সম্বন্ধ এ লিখেছেন। অবুঝ হিন্দুরা বর্তমানে সেটাকেও ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ধরে বসে আছে।কারণ মনসার সবচেয়ে বেশি উল্লেখ পাওয়া যায় এ গ্রন্থেই।
এছাড়াও মনসাবিজয় কাব্য নামেও আরেকটি মনুষ্য রচিত কল্পিত গ্রন্থ আছে।এই গ্রন্থে পার্বতীর মনসার এক চোখ দগ্ধ করার কাহিনিও বর্ণিত হয়েছে।
তাছাড়া বেহুলা লক্ষীন্দর এর প্রেম কাহিনী তো সবাই শুনেছেন।ওখানেও মনসার উল্লেখ আছে।আসল কথা হলো বেহুলা-লক্ষীন্দর বলুন আর মনসা সম্বন্ধে অন্য উপাখ্যান বলুন - সবই বানানো কাহিনী। ভেলায় ভেসে নাকি বেহুলা স্বর্গে চলে গিয়েছিলো!!!! কতো বড় হাস্যকর কথা বার্তা দেখুন।এই বিজ্ঞানেএ যুগে থেকেও মানুষ এসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন কথাবার্তা বিশ্বাস করে কি করে সেটাইই বুঝি না!!!!
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো যে,মূর্খ হিন্দুগুলো এসব মানুষ এর কল্পনা প্রসূত গল্প গুলোকেই ধর্ম বানিয়ে ছাড়ছে।
তার উপর সাধারণ হিন্দুদের টাকা নিয়ে বলি প্রথার চালু করেছে।।মনসা পূজোর পুরোহিত রা হলো সবচেয়ে ভন্ড।তারা ধর্ম সম্বন্ধে না জেনেই এক কোপে পাঠার মাথা কাটতে উদ্যত হয়।অথচ এই মনসা কোন দেবী ই নয়।।।
সেসকল ভন্ড ও পাষন্ডীরা জানে না সনাতন ধর্মে পশু বা প্রাণী হত্যা কি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।তারা বেদের নির্দেশ কে লঙ্ঘণ করার সাহস দেখায় এসকল মিথ্যা পূজায় পাঠাবলি দিয়ে!
প্রাণী হত্যা করলে যে দেবী সন্তুষ্ট হয় সে দেবী হয় কি করে!!! দেবীর কি খাবারের অভাব পড়েছে যে পাঠার মাংসই তার খেতে হবে!
মহাভারত তথা বেদে স্পষ্ট প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য রয়েছে -
সুরা মৎসা মধু মাংসমাসবং কৃসরোদনম্।
ধুর্তেঃ প্রবর্তিতং হোতন্নৈবদ্ বেদেষু কল্পিতম।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ ২৬৫,শ্লোক ৯)
---সুরা, মৎস, মধু, মাংস, তালরস, স্বাগু এইসব বস্তুকে ধুর্তেরাই যজ্ঞে প্রচলিত করেছে। বেদে এসব উপযোগের বিধান নেই।
অব্যবস্থিতমর্যদৈবিমূঢর্নাস্তিকৈর্তবৈ।
সংশয়াত্মাভিরব্যক্তৈহিংসা সমনুবর্তিত।।
(মহাঃ শান্তি পর্বঃ অঃ ২৬৫, শ্লোক ৪)
--- যে ধর্মের মর্যাদা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে মূর্খ, নাস্তিক তথা যার আত্মা সংশয়যুক্ত এবং যার কোন প্রসিদ্ধি নেই এইরূপ লোকই হিংসাকে সমর্থন করে।
মানান্মোহাচ্চ লোভাচ্চ লৌল্যমেত্যপ্রকল্পিতম্।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৬৫, শ্লোক ১০)
--- সেই ধূর্তেরা অভিমান, মোহ এবং লোভের বশীভূত হয়ে সেই সব বস্তুর প্রতি লোলুপতা প্রকট করে থাকে।
যজ্ঞের মহিমা বর্ণনার জন্য পিতামহ ভীষ্ম যুধিষ্ঠির কে এক উপ্যাখান শোনান। উপাখ্যান টি মহাভারতের শান্তি পর্বের ২৭২ নং অধ্যায়ে এসেছে। সেই উপখ্যানে এক ব্রাহ্মণ যিনি কি না যজ্ঞে পশু বলি দেবার কথা চিন্তা মাত্রেই তার সমস্ত তপস্যা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
তস্য তেনামুভাবনো মৃগহিংমমসাত্মনস্তদা।
তপো মহৎসমুচ্ছিন্নং তস্মাদ্হিংসান যজ্ঞিয়া।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ২৭২, শ্লোক ১৮)
----আমি সেই পশু কে বধ করে স্বর্গলোক প্রাপ্ত করবো। এই ভেবে মৃগকে হিংসা করার জন্য উদ্যত সেই ব্রাহ্মণের মহান তপস্যা তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই জন্য হিংসা যজ্ঞের জন্য হিতকর নয়।
এই জন্য বেদ আমাদের সর্বদা হিংসারহিত কর্ম করার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং আমাদের শরীর এবং দন্তের উপযোগী খাবার হিসেবে ভাত, ডাল,যব ইত্যাদি এসব খাবারের অনুমোদন দিয়েছে।
ব্রীহিমন্নং যবমত্তমথো মাষমথো তিলম ।
এষ বাং ভাগো নিহিতো রত্নেধেয়ায় দন্তৌ মা হিংসিষ্ট পিতরং মাতরং চ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০।২)
--- হে দন্ত! অন্ন খাও যব খাও মাষ কালাই এবং তিল খাও তোমার এই ভাগ উত্তম পদার্থ ধারনের জন্য স্থাপন করা হয়েছে হে দন্ত! পিতা ও মাতাকে হিংসিত করো না [মাংসাহার থেকে দূরে থাকো]
এবং বেদ মন্ত্রে সেই পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে যে, আমাদের দন্ত যেন ব্যাঘের ন্যায় না হয়। কারন বাঘের দন্ত সর্বদা মাংসাহার করে থাকে। সে জন্য আমাদের দন্ত কে ব্যাঘের ন্যায় না করে কল্যাণকারী করো।
যৌ ব্যাঘ্রাববরূঢৌ জিঘত্সতঃ পিতরং মাতরং চ।
তৌ দন্ত ব্রহ্মণস্পতে শিবৌ কৃণু জাতবেদঃ।।
(অথর্ববেদ ৬।১৪০।১)
--- যে দন্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় পিতা ও মাতাকে খাওয়ার জন্য চেষ্টা করে সেই দাঁত কে হে সর্বব্যাপক জ্ঞানের পরিপালক কল্যাণকারী করো।
অর্থাৎ বেদ আমাদের সর্বদাই কল্যাণকারী হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। যাতে করে আমাদের কাছ থেকে কেউ যেন কষ্ট না পায়। আমরা যেন নিরীহ প্রাণীদের হিংসা না করি। কারন, "অহিংসা পরম ধর্ম " (মহাঃ আদিঃ অঃ ১১, শ্লোঃ ১৩) এবং "হিংসা অধর্মস্তথহিত" (মহাঃ শান্তিঃ ২৭২, শ্লোক ১৮) হিংসা অধর্ম এবং অহিতকর। "প্রাণিনামবধস্তাত সর্বজায়ান্" (মহাঃ কর্ণ পর্ব, অঃ ২৬৯, শ্লোক ২৩) অর্থাৎ প্রাণীদের বধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
জীবিতুং যঃ স্বযং চেচ্ছেত্ কথং সোন্যং প্রঘাতয়েত।
যদ যদাৎমসি চেচ্ছেত তত পরস্যাপি চিন্তয়েত।।
(মহাঃ শান্তি পর্ব, অঃ ২৫৯, শ্লোক ২২)
উপরিউক্ত মন্ত্রগুলি দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, বেদ কোন নির্দোষ পশু কে হত্যার উপদেশ করে নি।বরং উপদেশ করেছে, পশুস্ত্রাঁয়েথাঙ (যজুর্বেদ ৬।১১) অর্থাৎ পশুদের রক্ষা করো এবং তাদের বর্ধিত করো।কারন বেদ সর্বদাই কল্যাণময়।
এবার আপনারাই বিবেচনা করুন যে কোন অবস্থাতেই বলি বা পশু হত্যা করা উচিত কি না।
আপনাদের কাছে কি ঈশ্বর কে অবিবেচক মনে হয় যে তিনি এক জায়গায় বলবে প্রাণী হত্যা নিষেধ আরেক জায়গায় দেবীর জন্য বলি দেয়া জায়েজ করে দেবেন!!!!!!
সবাই একটু বুঝতে চেষ্টা করুন এবং এ সকল ভন্ডামী কে প্রশ্রয় না দিয়ে এসব এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন।সনাতন ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ সম্বন্ধে সবাইকে সচেতন করতে পারলেই এসব ঘৃণ্য বলি প্রথা থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বিদের মুক্ত করা যাবে।
ওঁ শান্তি। ওঁ শান্তি। ওঁ শান্তি।
বলি প্রথা সনাতন সম্মত নয়, হোক সে যেকোন পুজো।
ReplyDelete