© চিন্তন দত্ত
প্রথমেই একটিমাত্র কথায় আমার মূল বক্তব্যটিকে পেশ করি।
আমার মতে এঁরা দু'জন যাজের ঔরসে কোনো এক বনচারী অন্ত্যজ জাতির (নিষাদও হতে পারেন) নারীর গর্ভে জাত পুত্র-কন্যা। দ্রুপদ এঁদের দত্তক নেন (অথবা ক্রয় করেন)।
এরপর মহাভারত অনুসারে প্রমাণ দিতে থাকব, এ হেন আজব চিন্তাকে বাস্তব মনে করার কারণ। পাঠকগণ অনুগ্ৰহ করে একটু ধৈর্য্য ধরে বসুন।
এই প্রবন্ধে প্রথমেই প্রবন্ধের সাধারণ নিয়মানুযায়ী আমার বক্তব্যকে সত্য বলে ধরে নিয়ে তারপর যুক্তিজাল সাজিয়ে সেটাকে প্রমাণ করার বদলে বরং একটা কাজ করা যাক। কয়েকটা সম্ভাবনার কথা ভেবে নেওয়া যাক, দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে। অবশ্যই আগুন থেকে জন্ম, এহেন কাল্পনিক ব্যাখ্যাকে সরিয়ে রেখে। তারপর আমরা একটা একটা করে সম্ভাবনা বাতিল করতে করতে বরং মূল উত্তরে পৌঁছব।
দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের প্রকৃত পরিচয়ের সম্ভাবনা:
১) দ্রুপদের ঔরসে তাঁর পত্নীর গর্ভে জন্ম। দ্রুপদের স্বয়ংজাত সন্তান।
২) দ্রুপদের ঔরসে ভিন্ন কোনো রমণীর গর্ভে জন্ম। দ্রুপদের স্বৈরিণীজ সন্তান।
৩) যাজ/উপযাজের ঔরসে দ্রুপদের রানীর গর্ভে জন্ম। দ্রুপদের প্রণীত/পরিক্রীত সন্তান।
৪) যাজ/উপযাজের ঔরসে ভিন্ন কোনো রমণীর গর্ভে জন্ম। দ্রুপদের দত্ত সন্তান।
৫) সম্পূর্ণ অজ্ঞাতকুলশীল। দ্রুপদের দত্ত/ক্রীত সন্তান।
প্রথমেই বলি, আমাদের অনেকেরই এই ধারণা আছে, দ্রোণবধের জন্য পুত্র চেয়ে যজ্ঞ করেছিলেন দ্রুপদ। তবে পুত্রের সঙ্গে একটি কন্যারও দরকার হল কেন? যে কন্যা কিনা পুত্রকেও চেয়েও ছাপিয়ে গেলেন দ্রুপদের অভীষ্ট সিদ্ধির পথের অস্ত্র হিসেবে?
দুঃখিত চিত্তে জানাই, এই ধারণা সর্বৈব ভুল। মহাভারতের কবি কোত্থাও বলেননি, দ্রোণবধের জন্য দ্রুপদ পুত্র চাইছিলেন। আমাদের মনে এই ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছেন মহাভারতের সুবিখ্যাত অনুবাদক ও টীকাকার হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহোদয়। প্রমাণ? আদিপর্বের ১৬০ তম অধ্যায়ের দ্বিতীয় শ্লোক- “নাস্তি শ্রেষ্ঠমপত্যং মে ইতি নিত্যমচিন্তয়ৎ”। মাননীয় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় যার অর্থ করেছেন, 'আমার উৎকৃষ্ট পুত্র নাই'- এমন চিন্তা দ্রুপদ সর্বদাই করিতে লাগিলেন। কিন্তু আপনারাই বলুন, অপত্য শব্দের অর্থ কিভাবে কেবল পুত্রই হতে পারে? অপত্য শব্দের আভিধানিক অর্থই তো পুত্রকন্যা বা সন্তান-সন্ততি।
হ্যাঁ, পরে যদিও উপযাজের কাছে তিনি দ্রোণবধের জন্য একটি সুযোগ্য পুত্রই চেয়েছিলেন, কিন্তু তবুও পুত্র হোক কন্যা হোক যে কোনো একটি উপযুক্ত সন্তানের কামনাতেই তিনি যে বিভোর ছিলেন- তার প্রমাণ পাওয়া যায় আদিপর্বের ১৬০ তম অধ্যায়েরই তৃতীয় শ্লোকে, যেখানে বলা হচ্ছে, তিনি পূর্বে জাত তাঁর পুত্র-কন্যাদের এবং বন্ধুবর্গকে ধিক্কার দিতে লাগিলেন- জাতান্ পুত্রান্ স নির্ব্বেদাদ্ধিগ্বন্ধুনিতি চাব্রবীৎ। অবশ্য সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় এখানেও পুত্রান্ শব্দের অর্থ পুত্র-কন্যার পরিবর্তে কেবল পুত্র করেছেন। পরপর দুটি বাক্যে যখন বলা হচ্ছে, তিনি উপযুক্ত সন্তান নেই বলে পরিতাপ করছেন এবং তাঁর অভীষ্ঠ সিদ্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় পূর্বজাত সন্তানদের গালমন্দ করছেন- তখন কি এ কথাই মনে হয় না, দ্রুপদের কামনা ছিল একটি সন্তানের, একটি অস্ত্রের, যে তাঁকে বিজয়ের স্বাদ এনে দিতে পারবে।
এর পরের শ্লোকেই বলা হচ্ছে, দ্রুপদ দ্রোণের প্রভাব, বিনয়, শিক্ষা এবং চরিত্র চিন্তা করিয়া ক্ষত্রিয়শক্তি দ্বারা তাঁহার পরাভবের সম্ভাবনা করিতে পারিলেন না- প্রভাবং বিনয়ং শিক্ষাং দ্রোণস্য চরিতানি চ/ ক্ষাত্রেণ চ বলেনাস্য চিন্তয়ন্নাধগচ্ছত। সুতরাং দ্রোণের ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতিকার তিনি ব্রাহ্মণ্যশক্তি দিয়েই করবেন বলে স্থির করলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে গঙ্গা ও যমুনার উভয় তীরস্থ সকল তপোবনে তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে সক্ষম এমন সিদ্ধ ব্রহ্মর্ষির সন্ধান করতে শুরু করলেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, পঞ্চাল কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের একটি পীঠস্থানবিশেষ ছিল। কর্ণপর্বে কর্ণ এবং শল্যের মধ্যেকার উত্তপ্ত বাদানুবাদের সময় মহাভারতের কবি কর্ণের মুখ দিয়ে পঞ্চালের সম্পর্কে বলিয়েছেন, পঞ্চাল দেশের মানুষেরা বেদবিহিত ব্রাহ্মণ্য ক্রিয়াকলাপের জন্যই বিখ্যাত- ব্রাহ্মং পাঞ্চালাঃ। ফলে সে দেশের রাজা হয়ে দ্রুপদের মনে যে ক্ষাত্রশক্তি অপেক্ষা ব্রাহ্মণ্যশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কোনো সন্দেহই থাকবে না এবং এই ব্রাহ্মণ্যশক্তিকে তিনি ভয় ও ভক্তি দুই-ই করবেন এবং কোনো কারণে ব্রাহ্মণ্যশক্তির হাতে পরাস্ত হলে তিনি ক্ষাত্রশক্তির বলে তাঁর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করার চেষ্টা না করে ব্রাহ্মণ্যশক্তির দ্বারাই ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতিকার করার চেষ্টা করবেন; সে কথা বলাই বাহুল্য। ©চিন্তন দত্ত
গঙ্গা-যমুনার পার্শ্ববর্তী তপোবনগুলিতে সন্ধান করতে করতে অবশেষে একদিন তাঁর প্রতীক্ষার অবসান হল। তিনি এমন একটি ব্রাহ্মণবসতি খুঁজে পেলেন, কবির ভাষায়, যেখানের কোনো ব্রাহ্মণই অস্নাতক বা অব্রতী ছিলেন না- তত্র নাস্নাতকঃ কশ্চিন্ন চাসীদব্রতীঃ দ্বিজঃ। তবে কিনা সিদ্ধান্তবাগীশ মহাশয় তাঁর 'ভারতকৌমুদী' গ্ৰন্থে এই শ্লোকটির টীকা করতে গিয়ে (এবং অবশ্যই বঙ্গানুবাদেও) অস্নাতক এবং অব্রতী না হওয়ার পাশাপাশি এই জনপদে বসবাসরত ব্রাহ্মণদের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা জুড়ে দিয়েছেন- এঁরা নাকি কেউই অব্রহ্মচারীও ছিলেন না, অর্থাৎ কায়মনোবাক্যে সদাসর্বদা ব্রহ্মচর্য পালন করতেন এঁরা। অথচ আমরা এইমাত্র দেখলাম, মূল শ্লোকে এই ব্রাহ্মণদের ব্রহ্মচারী হওয়া নিয়ে কোনো কথাই নেই।
পাঠক! এখানে একবার আমাদের থামতে হবে। ভাগীরথীতীরে যখন দ্রুপদ তাঁর হয়ে প্রতিশোধ নিতে সক্ষম ব্রাহ্মণের অনুসন্ধান করছেন তখন মহাভারতের কবি একটি অদ্ভুত কথা বললেন- “প্রতিকর্ত্তুং নরশ্রেষ্ঠো যতমানোহপি ভারতঃ। অভিতঃ সোহথ কল্মাষীং গঙ্গাকূলে পরিভ্রমন্।।” অর্থাৎ ভরতবংশীয় নরপতি তাঁর প্রতিশোধ গ্ৰহণেচ্ছু হয়ে গঙ্গাতীরে পরিভ্রমণ করতে লাগলেন। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টিকারী শব্দটি হল ঐ 'কল্মাষীং'। তার অর্থ কী?
নীলকণ্ঠ তাঁর 'ভারতভাবদ্দীপঃ'র টীকায় এবং সিদ্ধান্তবাগীশ তাঁর ভারতকৌমুদীর টীকায় বলেছেন, কল্মাষী বলতে এখানে যমুনাকেই বোঝানো হয়েছে- কল্মাষীং কৃষ্ণবর্ণাং যমুনামভিতঃ গঙ্গাকূলে চ পরিভ্রমন্, কারণ যমুনার ঘন কৃষ্ণ জল, যার উল্লেখ বিভিন্ন কাব্যে সুবিদিত। নীলকণ্ঠ তো আরও এগিয়ে বলেছেন, রাজা কল্মাষপাদের পুরীর নিকটবর্তী অঞ্চলে দ্রুপদ সন্ধান করছিলেন, তাই 'কল্মাষীং' শব্দটির প্রয়োগ- কল্মাষপাদস্য পুরীং কল্মাষীমভিতঃ সমীপে ইত্যন্যে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, মহাভারতের মহাকবি তো বিনা কারণে প্রায় কিছুই করেন না। নামের এত অভাব পড়েছিল যে ওইস্থানে 'কল্মাষীং' শব্দটি ছাড়া আর কিছু দেওয়া যেত না? নাকি এই 'কল্মাষ' এখানে অন্য কিছুর বার্তাবহ? কালো মানুষদের বাসভূমির কাছাকাছি বলেই কি 'কল্মাষ' শব্দের প্রয়োগ? কালো নদীর সঙ্গে কালো মেয়ের কি একটা অদ্ভুত মিল পাওয়া যাচ্ছে না? এখানে ধৃষ্টদ্যূম্নের কথা সচেতনভাবেই বললাম না, কারণ ধৃষ্টদ্যূম্নের চেয়ে দ্রৌপদী অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র; তাঁর গাত্রবর্ণের ব্যাখ্যা দিতে মহাভারতকার যতখানি আগ্ৰহী হবেন, তাঁর গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ হওয়ার কারণ সম্পর্কে যতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূত্র ছেড়ে যাবেন ভাবীকালের পাঠকদের উদ্দেশ্যে, ধৃষ্টদ্যূম্ন সম্পর্কে ততগুলি সূত্র না ছেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
যাই হোক, সেই অঞ্চলে দ্রুপদ যাজ ও উপযাজ নামক দু'জন শমগুণান্বিত, ব্রহ্মতেজে ভরপুর দুই ঋষির সন্ধান পেলেন; আশ্বস্ত হলেন এঁদের কাছেই তিনি অভীষ্ট ফল লাভ করতে পারবেন।
দ্রুপদ ছোট ভাই উপযাজের কার্যত পায়ে পড়ে গেলেন। অর্বুদ অর্বুদ দুধেল গাই দেওয়ার লোভ দেখিয়ে উপযাজকে বশ করার চেষ্টা করলেন তিনি। সেই ফাঁকে আরও একবার বলে নিলেন তিনি তাঁর উদ্দেশ্য- দ্রোণবধের জন্য তাঁর উপযুক্ত পুত্র চাই- পুত্রঃ স্যাৎ দ্রোণমৃত্যবে। দ্রুপদের প্রথমে কী আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা আমরা দেখেছি এখন দ্রুপদ কি চাইছেন তাও দেখছি। এর থেকে এই সিদ্ধান্তেই আসা যায় যে, একজন উপযুক্ত সন্তান পেলেই দ্রুপদ খুশি, কিন্তু আপাতত তাঁর ফার্স্ট প্রেফারেন্স পুত্রই, কন্যা নয়। কিন্তু উপযাজ পত্রপাঠ তাঁর প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন।
আচ্ছা, দ্রুপদ কেন কনিষ্ঠ ভ্রাতা উপযাজের কাছে গেলেন? কেন জ্যেষ্ঠ যাজের কাছে নয়? এর উত্তরও দেওয়া আছে মহাভারতেই।
মহাভারত বলছে, ‘সেখানে তাঁহাদের ক্ষমতা বুঝিতে পারিয়া সমস্ত অভীষ্ট বস্তু দান করিবার অঙ্গীকারের প্রলোভন দেখাইয়া ব্রতচারী কনিষ্ঠ উপযাজের শরণাপন্ন হইলেন'। এই বাক্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হল, ‘সেখানে তাঁহাদের ক্ষমতা বুঝিতে পারিয়া'।
আগেই বলেছি, পাঞ্চালরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অত্যন্ত পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সেই সঙ্গে কে খাঁটি ব্রাহ্মণ আর কে নয়, সে সম্পর্কে তাঁদের বাছবিচারও ছিল যথেষ্ট। ব্রাহ্মণত্বের অন্যতম সাধনা যে শম-দমের সাধনা, সেখানে লোভের অবস্থান একেবারেই দৃষ্টিকটু। কিছুক্ষণ পরেই আমরা দেখতে পাব, কনিষ্ঠ ভ্রাতা হয়েও উপযাজ তাঁর জ্যেষ্ঠ সম্পর্কে মন্তব্য করছেন, তিনি অত্যন্ত অর্থগৃধ্নু এবং অর্থের জন্য পারেন না এমন কোনো কাজ নেই।
ব্রাহ্মণের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল যজন-যাজন-অধ্যয়ন-অধ্যাপনা-দান-প্রতিগ্ৰহ। কিন্তু সত্যি বলতে কি, প্রথম চারটিকে ব্রাহ্মণের প্রধান কর্তব্য বলে ধরে নিলেও শেষ দুটি, অর্থাৎ যার দ্বারা তাঁদের গ্ৰাসাচ্ছাদন চলত, সেগুলিকে খুব একটা ভালো চোখে কেউই দেখতে পারতেন না। এমনকি আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ব্রাহ্মণের দান-দক্ষিণার প্রতি আগ্ৰহকে আমরা একটু বাঁকা চোখেই দেখি। এই ধনাকাঙ্খার জন্যই মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও দ্রোণ 'ব্রাহ্ম' পঞ্চালে যথাযোগ্য সম্মান পাননি, এমনকি ব্রাহ্মণ্যসমাজের কাছে ক্রমাগত নিন্দিত হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কৌলিক বৃত্তিত্যাগের সিদ্ধান্তও তাঁকে নিতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে।
অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক পঞ্চালে অর্থলোভী ব্রাহ্মণদের যে খুব একটা ভালো চোখে যে দেখা হত না- এটা পরিষ্কার। সে কারণেই যোগ্য, হয়তো বা যোগ্যতর হওয়া সত্ত্বেও যাজের কাছে না গিয়ে দ্রুপদ গিয়েছিলেন তাঁর অনুজ উপযাজের কাছে। যাজের প্রতি তাঁর ঘৃণা আরো প্রকটিত হয়, উপযাজ কর্তৃক তিনি পুনরায় যাজের কাছে প্রেরিত হওয়ার সময় তাঁর ব্যবহার দেখে, তিনি মনে মনে নিন্দা করতে করতেই যাজের কাছে গিয়েছিলেন বা বলা ভালো যেতে বাধ্য হয়েছিলেন- জুগুপ্সোমানো নৃপতির্মনসেদং বিচিন্তয়ন্।
উপযাজ প্রথমে দ্রুপদকে প্রত্যাখ্যান করলেও দ্রুপদ হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। দীর্ঘ একবছর ধরে অক্লান্তভাবে উপযাজের সেবা করে গেলেন তিনি। অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে উপযাজ দ্রুপদকে তাঁর দাদা যাজের শরণাপন্ন হতে বললেন। কারণ হিসেবে যা বললেন, তা অতি চমকপ্রদ। আমি আপনাদের সুবিধার্থে উপযাজের এই বক্তব্যের সংস্কৃত এবং বাংলা অনুবাদ পাশাপাশি তুলে দিচ্ছি।
জ্যেষ্ঠো ভ্রাতা মমাগৃহ্মাদ্বিচরন্ গহনে বনে।
অপরিজ্ঞাতশৌচায়াং ভূমৌ নিপতিতং ফলম্॥
বঙ্গানুবাদ: একদা আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা নিবিড় বনে বিচরণ করিতে থাকিয়া ভূমির পবিত্রতা না জানিয়েই তাহাতে নিপতিত একটি ফল গ্রহণ করিয়াছিলেন।
তদপশ্যমহং ভ্রাতুরসাম্প্রতমনুব্রজন্।
বিমর্শং সংকরাদানে নায়ং কুর্যাৎকদাচন॥
বঙ্গানুবাদ: আমি পিছনে যাইতে যাইতেই ভ্রাতার সেই অসঙ্গত কার্য দেখিয়াছিলাম; সুতরাং উনি কোনো সঙ্করদোষযুক্ত বস্তু গ্রহণ করিতে কদাপি বিবেচনা করিবেন না।
দৃষ্ট্বা ফলস্য নাপশ্যদ্দোষান্পাপানুবন্ধকান্।
বিবিনক্তি ন শৌচং যঃ সোঽন্যত্রাপি কথং ভবেৎ॥
বঙ্গানুবাদ: যিনি ফলটি দেখিয়াই তাহার পাপের কোনো পর্যালোচনা করেন নাই এবং তাহার পবিত্রতার বিষয়ক কোন বিবেচনা করেন নাই, তিনি অন্য স্থানেই বা কেন তাহা করিবেন?
সংহিতাধ্যযনং কুর্বন্বসন্গুরুকুলে চ যঃ।
ভৈক্ষমুৎসৃষ্টমন্যেষাং ভুঙ্ক্তে স্ম চ যদা তদা॥
বঙ্গানুবাদ: তিনি গুরুগৃহে বাস করিবার সময় বেদ পাঠ করিতেন, অথচ যখন তখন অন্যের উচ্ছিষ্ট ভিক্ষান্ন ভোজন করিতেন।
কীর্তয়ন্গুণমন্নানামঘৃণী চ পুনঃ পুনঃ।
তং বৈ ফলার্থিনং মন্যে ভ্রাতরং তর্কচক্ষুষা॥
বঙ্গানুবাদ: উপরন্তু ঘৃণাশূন্য হইয়া বারবার সেই অন্নের প্রশংসা করিতেন। সুতরাং সেই ভ্রাতাকে আমি তর্কের দৃষ্টিতে ধনলোভী বলিয়াই মনে করি।
মহাভারতের বহু গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় চরিত্রকে মহাভারতকার কঠোর হৃদয়ে মহাকাব্যের রথচক্রের তলায় নিষ্পেষিত করে দিয়েছেন। সেই তিনি কেবল একটা ফল খাওয়া নিয়ে পাঁচ-পাঁচখানা শ্লোক লিখে যাবেন, এ কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাছাড়া মাটিতে পড়ে থাকা নাম-না-জানা ফল খাওয়ার মতো অত্যন্ত তুচ্ছ একটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করেই স্থির হচ্ছে কে যজ্ঞসেনের হয়ে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার উপযুক্ত- এটাও মেনে নিতে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয়।
আচ্ছা, এমন যদি হয়, ভূমির পবিত্রতা না জেনে তাতে নিপতিত ফল গ্ৰহণ করার আড়ালে যদি অজ্ঞাতকুলশীল কোনো রমণীকে যাজের গ্ৰহণ করার কথা বলা হয়ে থাকে, তাহলে? হতেই পারে, সে রমণীর গাত্রবর্ণ ছিল কালো; 'কল্মাষী'র কাছাকাছিই বাস যখন। উপযাজ সে সময় যাজের পিছন পিছন গিয়ে যাজের এই কাজের সাক্ষী হয়েছিলেন। হয়তো দ্রুপদ দত্তক নয়, উপযাজের কাছে একটি প্রণীত পুত্রের (ক্ষেত্রজ পুত্র; বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভে যদি কোনো শ্রেষ্ঠতর পুরুষের ঔরসে সন্তানের জন্ম হয় তবে সেই সন্তানকে প্রণীত সন্তান বলা হয়) জন্ম দেওয়ার আকাঙ্খা নিয়েই এসেছিলেন। উপযাজ এই কার্যে অস্বীকৃত হলে তিনি দ্রুপদকে পাঠান তাঁর বড়ভাই যাজের কাছে, একটি পরিক্রীত পুত্রের (অন্য কোন পুরুষকে যদি ধনের লোভ দেখিয়ে বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়, তবে সেই মিলনজাত সন্তান পরিক্রীত নামে পরিচিত হয়) জন্ম দেওয়ার আবেদন করার পরামর্শ দিয়ে। সে জন্যই হয়তো উপযাজের বক্তব্য, “তিনি যে কাজ একবার করেছেন, সে কাজ দ্বিতীয়বার করতেই বা আপত্তি কোথায়?” বড় ভাইয়ের প্রতি উপযাজের ঘৃণা আরও স্পষ্ট হয়, যখন তিনি বলেন, “তিনি গুরুগৃহে বাস করিবার সময় বেদ পাঠ করিতেন, অথচ যখন তখন অন্যের উচ্ছিষ্ট ভিক্ষান্ন ভোজন করিতেন।” যদিও এখানে স্পষ্টভাবে 'ভিক্ষান্ন' বলে উল্লেখ করেই দেওয়া হয়েছে, তবুও উচ্ছিষ্ট ভিক্ষান্ন খাওয়া এবং তার প্রশংসা করার আড়ালে আমার কূট মস্তিষ্কে অন্য কোনোরকম ধারণার উদ্ভব হয়, তবে সে কথা প্রকাশ্যে না বলাই ভালো।®চিন্তন দত্ত
যাই হোক, দ্রুপদ যাজের এই অসঙ্গত কাজের জন্য তাকে মনে মনে গাল পাড়তে পাড়তেও উপায়ান্তর না দেখে তাঁর পায়েই গিয়ে পড়তে বাধ্য হলেন। সেখানে দ্রোণের ধনুর্বেদে পারঙ্গমতা ও তার ফলে তাঁর নিজের শোচনীয় পরাজয়ের কথা বলে যাজের মন কিঞ্চিৎ আর্দ্র করে 'ব্রাহ্ম' পঞ্চালের রাজার উপযুক্ত কথাই বলে বসলেন, “মহাধনুর্ধর ও মহামনা সেই দ্রোণ নিশ্চয়ই তাঁর ব্রাহ্ম তেজেই ক্ষাত্র তেজ প্রতিহত করেন”। অর্থাৎ, দ্রুপদ কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না, তাঁর সহপাঠী আপন অধ্যবসায়ের গুণেই তাঁকে ছাড়িয়ে গেছেন, তিনি এখনও মনে করে চলেছেন দ্রোণের এই তেজের পিছনে রয়েছে কেবলই তাঁর জন্মমাহাত্ম্য।
এতেই শেষ নয়, দ্রুপদ আরও বললেন, “আহুতিপ্রাপ্ত অগ্নির ন্যায় তিনি (দ্রোণ) ব্রাহ্ম তেজ ধারণ করেন এবং সেই ব্রাহ্মতেজকে অগ্রবর্তী করিয়া ক্ষাত্র তেজ ধারণপূর্বক যুদ্ধে বিপক্ষদিগকে ধ্বংস করেন। বিধাতা ব্রাহ্ম ও ক্ষাত্র এই দুইটি তেজ সৃষ্টি করিয়াছেন, তন্মধ্যে ব্রাহ্ম তেজই শ্রেষ্ঠ। সেই জন্যই আমি ক্ষাত্র তেজ থাকিতেও ভীত হইয়া ব্রাহ্ম তেজেরই আশ্রয় গ্ৰহণ করিয়াছি।”
অবশেষে আগের বহুবারের মতোই যাজের কাছে তিনি সবিনয়ে প্রার্থনা করলেন, এই ব্রাহ্মশক্তির বিরুদ্ধে ক্ষাত্রশক্তি দিয়ে লড়তে তিনি অপারগ, ব্রাহ্মণ্যশক্তির প্রতিকার করতে তাঁর প্রয়োজন অধিকতর তেজীয়ান ব্রাহ্মশক্তি, যা দ্রোণের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর বেদজ্ঞ যাজই তাঁকে দিতে পারেন। যাজের ব্রাহ্মশক্তির সাহায্য পেলে তিনি যুদ্ধে দুর্জয় ও দ্রোণহন্তা পুত্রলাভ করবেন।
বারংবার ব্রাহ্ম শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ব্রাহ্ম শক্তির কামনা করা (এবং অবশ্যই সে শক্তির নাম ধৃষ্টদ্যূম্ন)- এ কথা কি ধৃষ্টদ্যূম্নের শরীরে দ্রুপদের ক্ষাত্রতেজ তথা ক্ষাত্ররক্তের পরিবর্তে ব্রাহ্মতেজ তথা ব্রাহ্মরক্তের উপস্থিতির কথাই সুপ্রমাণ করে না? এতবার দ্রুপদ ক্ষাত্রশক্তির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে ব্রাহ্মতেজযুক্ত শক্তি চেয়েছেন, তাতে করে স্পষ্টই মনে হয় দ্রুপদ নিজের তেজের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়েছেন এবং সেই তেজে জাত সন্তান তাঁর কখনোই কাম্য ছিল না। অন্যথায় তাঁর কাছে শিখণ্ডী, যুধামন্যু, উত্তমৌজা (শেষ দু'জন দ্রুপদেরই সন্তান কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চয়তা অবশ্য মহাভারতের কোথাও দেওয়া হয়নি)- প্রমুখ মহা মহা বীরেরা তো ছিলেনই, তাঁদের গালমন্দ করে নতুন পুত্র তিনি চাইবেনই বা কেন? আর যদি এঁদের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ক্ষাত্রতেজে বলীয়ান একটি নতুন সন্তান তিনি চাইতেনই, তবে তো নিজের ঔরসেই যে কোনো নারীর গর্ভেই তিনি সন্তানের জন্ম দিতে পারতেন, এত লুকোছাপা এবং ব্রাহ্মশক্তির প্রতি এত আগ্ৰহের তো কোনো কারণ দেখি না। আর যদি এঁরা দ্রুপদের কোনো গোপন প্রণয়ের ফসল হন, তবে দ্রুপদ পূর্বেই এদের বার করতে পারতেন, খামোকা নিজের পরাজয়ের জন্য অপেক্ষা করবেন কেন? আর এই যুক্তিও খারিজ হয়ে যায় ক্ষাত্রতেজের প্রতি তাঁর অনাগ্ৰহ ও ব্রাহ্মতেজের প্রতি অতিরিক্ত আগ্ৰহের কারণে। কাজেই দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্ন যাঁরই ঔরসজাত সন্তান হোন না কেন, দ্রুপদ যে এঁদের Biological father নন- এ কথা প্রায় নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে।
এই সিদ্ধান্তে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হয়ে গেল দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের প্রকৃত পরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সম্ভাবনা। ব্রাহ্মরক্তের প্রতি দ্রুপদের আগ্ৰহাতিশয্যের কারণে নির্দ্বিধায় বাদ দেওয়া চলে দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের অজ্ঞাতকুলশীল হওয়ার পঞ্চম সম্ভাবনাটিকেও।
তাহলে এখন প্রশ্ন হল, দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্ন কার ঔরসজাত সন্তান?
আচ্ছা, যাজের সঙ্গে দ্রুপদের কথোপকথনের অংশটি একবার খেয়াল করুন তো। সেই যাজ, যাঁকে দ্রুপদ নিজেই বড় একটা সুনজরে দেখেন না, তাঁর উদ্দেশ্যে “আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ, আপনিই কেবল আমাকে সাহায্য করতে পারেন” এবং উপযুক্ত মূল্য পাওয়া মাত্রই যাজের এই অনুরোধ স্বীকার করা- ইত্যাদি বিষয় কি এই দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে না, যে, ধৃষ্টদ্যূম্নের ধমনীতে প্রবাহিত ব্রাহ্মরক্তের উৎস আর কেউ নন, স্বয়ং যাজ? তাছাড়া উপযাজের কাছে দ্রুপদ যখন প্রথম এই প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন তখন তিনি তৎক্ষণাৎ তা নাকচ করে দেন। বছর ঘুরলে দ্রুপদের প্রতি তাঁর খানিকটা মায়া জন্মালেও নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অনড় ছিলেন, তাই নিজে দ্রুপদের প্রস্তাব গ্ৰহণ না করে তাঁকে পাঠিয়েছিলেন যাজের কাছে। এতকিছুর পরেও, এবং সর্বোপরি ব্রাহ্মণেতর বর্ণ বা জাতির রমণীদের প্রতি তাঁর যা মনোবৃত্তি, তাতে তিনি দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নকে জন্ম দেওয়ার জন্য কোনো অব্রাহ্মণ রমণীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন- এ একেবারেই অসম্ভব।
দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কিত যে পাঁচটি সম্ভাবনার কথা আমরা বিচার করেছিলাম, তার মধ্যে ইতিমধ্যেই বাদ গেছে, তিনটি সম্ভাবনা- পড়ে আছে কেবল দুটি, চতুর্থ এবং পঞ্চম। দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্ন যাজ/উপযাজের ঔরসে পঞ্চালরাজ্ঞীর গর্ভে জাত সন্তান অথবা অপরাপর কোনো নারীর গর্ভে জাত। যাজকে মূল্য দেওয়ার লোভ দেখানোর ফলে এখনও পর্যন্ত দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের দ্রুপদের পরিক্রীত সন্তান হওয়ার সম্ভাবনার দিকেই, অর্থাৎ রাজ্ঞীর গর্ভে জাত হওয়ার দিকেই পাল্লা ভারী হয়ে আছে। দেখা যাক, যুক্তির স্রোত আমাদের শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায়।© চিন্তন দত্ত
দ্রুপদের কাছ থেকে যথেষ্ট সংখ্যক পয়স্বিনী গাভী দান হিসেবে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে যাজ সন্তুষ্ট হলেন। উপযাজকে নির্দেশ দিলেন রাজাকে যজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কথা বলে দিতে। নির্দিষ্ট সময়ে বিধি অনুসারে যজ্ঞও সম্পন্ন হল।
কিন্তু এরপরেই কাহিনীতে মোচড়। হঠাৎ করে যাজ, দ্রুপদের রানীকে (এখানে তাঁকে পৃষতি বলে সম্বোধন করা হয়েছে। প্রবল সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে, তবুও পুত্রবধূ কন্যাসমা- এই নির্দোষ কথা ভেবেই আপাতত এই বিতর্কের ওপর যবনিকা টানি।) ডেকে বললেন আপনার যমজ সন্তান উপস্থিত হয়েছে- পৃষতি! মিথুনং ত্বামুপস্থিতম্।
প্রচণ্ড খটকা লাগছে। উপস্থিত? উপস্থিত হয়েছেন ধৃষ্টদ্যূম্ন এবং দ্রৌপদী? জন্মাননি? তবে কি আগেই জন্মেছেন তাঁরা, এখন কেবল কাম্পিল্যে উপস্থিত হয়েছেন? আর সর্বোপরি, কোথায় উপস্থিত হয়েছেন তাঁরা? এখনও তো যজ্ঞবেদী থেকে তাঁদের উত্থান ঘটেনি!
যাকগে, তা দ্রুপদের মহিষী কী করলেন এই এত আনন্দের সংবাদ শুনে? তিনি অম্লানবদনে বললেন, “ব্রাহ্মণ! আমি এখনো মুখ প্রক্ষালন করি নাই এবং স্নান না করার অঙ্গে এখনও তেলের সুন্দর সৌরভ রহিয়াছে। অতএব যাজ! একটু অপেক্ষা করুন, পুত্র আমার প্রিয় হইলেও আমি এখনই হব্য গ্রহণ করিতে পারিব না।”-
অবলিপ্তং মুখং ব্রহ্মন্দিব্যান্গন্ধান্বিভর্মি চ।
সূতার্থে নোপলব্ধাঽস্মি তিষ্ঠ যাজ মম প্রিয়ে॥
রাজ্য রক্ষা পাবে, রাজার হৃতসম্মান পুনরুদ্ধার হবে, দুই পঞ্চাল আবার একত্রিত হবে- এমন এক সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে রানী কি বলছেন? না, মুখ ধোননি এবং স্নান করেননি- কাজেই হব্য গ্ৰহণ করতে পারবেন না। প্রজারা উৎকণ্ঠিত হয়ে নিঃশ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে, রাজ্যের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে যে যজ্ঞের সঙ্গে সেই যজ্ঞে প্রধানা মহিষীর এমন গা-ছাড়া মনোভাব? সম্ভব? আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মী-সরস্বতী পুজো হলেই তো সকাল থেকে সাজ সাজ রব পড়ে যায়!
রানী কি প্রথমে এই দত্তক পুত্রদের সহজে স্বীকার করতে পারেননি? এই আচরণ থেকে এবং পরবর্তীতে তাঁর একটি মন্তব্য থেকে কিন্তু সে সম্ভাবনার পাল্লাই ভারী হয়।
যজ্ঞাগ্নি থেকে প্রথমে বেরিয়ে এলেন বর্ম পরিহিত, অস্ত্রধারী, অগ্নিবর্ণ ধৃষ্টদ্যূম্ন। বেরিয়ে এসেই তিনি রথে চড়ে একবার পাঞ্চালদের সামনে নিজের চেহারাখানি দেখিয়ে এলেন। সাধু সাধু রব পড়ে গেল চতুর্দিকে। দৈববাণী হল, দ্রোণবধের জন্য জাত এই কুমার পাঞ্চালদের ভয় দূর করবে, যশ বৃদ্ধি করবে এবং রাজার শোকও অপনীত করবে। দৈববাণীর সংবাদ পাওয়া মাত্র প্রজাদের আনন্দোল্লাসে মেদিনী বিদীর্ণ হওয়ার উপক্রম হল।
তারপর বেরিয়ে এলেন যাজ্ঞসেনী। তিনি সৌভাগ্যশালিনী, সুদর্শনা এবং কৃষ্ণ আয়তচক্ষুযুক্তা। তিনি শ্যামাঙ্গী, পদ্মপলাশাক্ষী, কুঞ্চিত ঘনকালো কেশবতী এবং তাম্রবর্ণ নখ, সুন্দর ভ্রূযুক্তা। তিনি মানুষের শরীরে সাক্ষাৎ দেবী। তাঁর নীলপদ্মের ন্যায় অঙ্গসৌরভ একক্রোশ দূরেও অনুভূত হয়। তিনি পরম সুন্দর রুপধারিণী এবং সমগ্র বিশ্বে তুলনাহীনা। এই দেবরূপিনী কন্যা দেব, দানব ও যক্ষেরও আকাঙ্ক্ষিত:
কুমারী চাপি পাঞ্চালী বেদীমধ্যাৎ সমুত্থিতা ।
সুভগা দর্শনীয়াঙ্গী স্বসিতায়তলোচনা ।।
শ্যামা পদ্মপলাশাক্ষী নীলকুঞ্চিতমূর্ধজা ।
তাম্রতুঙ্গনখী সুভ্রূশ্চারুপীনপয়োধরা ।।
মানুষং বিগ্রহং কৃত্বা সাক্ষাদমরবর্ণিনী ।
নীলোৎপলসমগন্ধ যস্যাঃ ক্রোশাৎ প্রবায়তি ।।
যা বিভর্তি পরং রূপং যস্যা নাস্ত্যুপমা ভুবি ।
দেবদানবযক্ষাণামীপ্সিতাং দেবরূপিণীম ।।
দ্রৌপদীর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী হল, এই কুমারীর নাম হবে কৃষ্ণা এবং এ ক্ষত্রিয়দের বিনাশের কারণ হবে। এর জন্যই কুরুবংশের গুরুতর ভয়ের কারণ জন্মাবে।
পাঞ্চালদের গর্জনে এবার যেন আকাশ ভেদ করল। বেশ বুঝতে পারি, কুরুদের ধ্বংসের খবর শুনেই তাদের অমন হর্ষোল্লাস, কিন্তু তার মধ্যেও পুরো দৈববাণীটা শুনলে বোধ করি ভালো হত। শুধু কুরুবংশ নয়, সমগ্ৰ ক্ষত্রিয়কূলেরই ধ্বংসের বার্তা বহন করে নিয়ে এলেন এই অগ্নিজাতিকা। যাক, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
অবশেষে যাজের উদ্দেশ্যে ভেসে এল পঞ্চালরাজ্ঞীর সেই অবাক করা বক্তব্য, “ইহারা যেন আমাকে ছাড়া অন্যকে জননী বলিয়া না জানে”- ন বৈ মদন্যাং জননীং জানীয়াতামিমাবিতি।
এখানেই শেষ নয়, আরও অবাক করা বক্তব্য রাখলেন স্বয়ং বেদব্যাস। তিনি কথক ব্রাহ্মণের (দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের আবির্ভাবের পুরো ঘটনাটাই পাণ্ডবরা শুনছিলেন এক ব্রাহ্মণের মুখে) মুখ দিয়ে বলালেন, “যাজও রাজার সন্তোষ জন্মাইবার ইচ্ছায় মহিষীকে বলিলেন, তাহাই হইবে”- তথেত্যুবাচ ত্বাং যাজো রাজঃ প্রিয়চিকীর্ষয়া।
কয়েকটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠে আসে এই দুটি পরপর শ্লোক থেকে।
১) যদি দ্রুপদের মহিষী দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের গর্ভধারিণী জননীই হন, তবে তিনি বলবেন কেন, ”ইহারা যেন আমাকে ছাড়া অন্যকে জননী বলিয়া না জানে”? তবে কি তিনি এদের গর্ভধারিণী নন? এঁদের অপর কোনো জননী রয়েছেন? তিনিই এদের গর্ভধারিণী? কে তিনি?
২) বেদব্যাস বললেন কেন, যাজ রাজাকে 'সন্তুষ্ট করার জন্য' রাজমহিষীকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করলেন? তবে কি আমাদের পূর্ববর্তী সন্দেহই সঠিক? রাজ্ঞী দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের জন্মদাত্রী মা নন? তিনি অন্য কেউ? কেবল রাজাকে সন্তুষ্ট করতেই যাজকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে এবং মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছে? পরিস্থিতি তো অন্তত সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
কিছুক্ষণ আগেই আমরা বলেছিলাম, দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্ন দ্রুপদের পরিক্রীত পুত্র হওয়াই বেশি সম্ভব। কিন্তু রাজ্ঞী এবং যাজের এই বক্তব্যের পর এই ধারণা থেকে আমাদের সরে আসতেই হচ্ছে। দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্ন যেমন দ্রুপদের অংশজাত নন, তেমনি দ্রুপদের মহিষীর রক্তও বইছে না তাঁদের ধমনীতে।
এর আগেই দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের প্রকৃত পরিচয়ের সম্ভাবনাগুলির মধ্যে প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম সম্ভাবনা বাদ গিয়েছে। এখন বাদ গেল চতুর্থ সম্ভাবনাটিও। অতএব এখন কেবল একটিমাত্র সম্ভাবনাতেই আমাদের সিলমোহর দিতে হবে। দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্ন নিশ্চিতভাবেই যাজের ঔরসে কোনো ভিন্ন রমণীর গর্ভে জাত সন্তান। তিনি দ্রুপদের দত্ত বা ক্রীত সন্তান। ©চিন্তন দত্ত
সত্যি বলতে কি, যাজকে দ্রুপদের পয়স্বিনী গাভী দেওয়ার ঘটা দেখলে দত্তের পরিবর্তে ক্রীত সন্তান মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আবার উপযাজ, যাজের অর্থগৃধ্নুতার যে পরিচয় দিয়েছেন তাতে যাজ যে বিনামূল্যে তাঁর সন্তানদের রাজার হাতে ছেড়ে দেবেন, এমনটাও মোটেই মনে হয় না। সুতরাং সব দিক বিবেচনা করে দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নকে দ্রুপদের ক্রীত সন্তান বলাই উচিত, যাঁদের জন্ম যাজের ঔরসে কোনো এক অজ্ঞাতপরিচয় রমণীর গর্ভে।
এখন আমাদের লক্ষ্য সেই অজ্ঞাতপরিচয় রমণী, অর্থাৎ দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের মাতার প্রকৃত পরিচয় খুঁজে বের করা, যদিও তা মোটেই সহজ হবে না।
আচ্ছা, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, খানিকক্ষণ আগে, উপযাজের মুখে যাজের 'ভূমির পবিত্রতা না জানিয়াই' একটি ফল গ্ৰহণ করার ঘটনার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা বলেছিলাম, এই ঘটনার রূপকে যাজের সঙ্গে কোনো অজ্ঞাতকুলশীল, সম্ভবত কৃষ্ণবর্ণের কোনো রমণীর মিলনের কথা বলা হয়েছে? দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্ন এই মিলনের ফলে জাত সন্তান হওয়া কি খুবই অসম্ভব? হয়তো যাজ তাঁর এই সন্তানদের আপন পরিচয়ে পরিচিত করাননি, ব্রাহ্মণের উপযুক্ত জাতকর্ম করাননি, কিন্তু যোগাযোগ ঠিকই রেখেছিলেন। হয়তো তাঁরা মাতুলালয়েই বেড়ে উঠেছিলেন এবং সেখানেই ধৃষ্টদ্যূম্ন শস্ত্রবিদ্যার প্রাথমিক পাঠটুকু সমাপ্ত করেছিলেন। দ্রৌপদীর স্বাধীনচেতা লৌহকঠিন মনোভাবও হয়তো ব্রাহ্মণ্য সমাজের নিয়মের নিগড়ের বাইরে অবস্থিত এই স্বাধীন জনজাতির থেকেই প্রাপ্ত। অথবা এসব কিছু নাও হতে পারে। যাজ হয়তো তাঁর সন্তানদের তাঁর আশ্রমেই রেখেছিলেন এবং প্রতিবেশী কোনো ধনুর্বেদজ্ঞ ঋষির কাছেই শস্ত্রবিদ্যার প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন ধৃষ্টদ্যূম্ন। মনে রাখতে হবে, ধৃষ্টদ্যূম্ন মহারথী ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর যুদ্ধবিদ্যা ভীমার্জুন বা ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের সমতুল্য ছিল না এবং সেই শিক্ষাটুকুর বেশিরভাগও তাঁর দ্রোণের কাছ থেকেই প্রাপ্ত।
- এবার আমাদের নবলব্ধ সিদ্ধান্তগুলির ওপর ভিত্তি পুরো বিষয়টা শুরু থেকে একবার পুনর্গঠন করা যাক।
দ্রোণের কাছে পরাজিত হয়ে এবং অর্ধেক রাজ্য হারিয়ে দ্রুপদ তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উপযুক্ত সন্তান লাভের আশায় গঙ্গা-যমুনার তীরবর্তী তপোবনগুলিতে হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগলেন। পঞ্চালের তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতিতে তাঁর মনে এই বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছিল যে, দ্রোণ কেবল ব্রাহ্মশক্তির বলে বলীয়ান হয়েই তাঁর ক্ষাত্রশক্তিকে পর্যুদস্ত করেছেন। কাজেই দ্রোণের ব্রাহ্মশক্তিকে খণ্ডন করার উদ্দেশ্যে তিনি দ্রোণের চেয়েও শক্তিশালী ব্রাহ্মশক্তির অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। অবশেষে যমুনাতীরস্থ অনার্য [ এই অনার্য সম্বোধন আমরা অস্বীকার করি যদিও - আপ্লোডকর্তা ] অধিবাসীদের বাসস্থানের নিকটবর্তী এক তপোবনে যাজ ও উপযাজ নামক দুই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সন্ধান পেয়ে তিনি তাঁদের অনুরোধ করেন তাঁর মহিষীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে, বিনিময়ে বহু ধনের লোভও দেখান তিনি। প্রথমে তিনি কনিষ্ঠ উপযাজের কাছেই গিয়েছিলেন, তিনি দ্রুপদকে পাঠান তাঁর দাদা যাজের কাছে। যাজের কাছে তিনি পুনরায় এই আবেদন জানালে যাজ সম্ভবত তাঁকে তাঁর যমজ পুত্র-কন্যার সম্পর্কে অবহিত করেন। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে চোখ রেখে একজন সদ্যোজাত শিশু অপেক্ষা দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান লাভ দ্রুপদের কাছেও লাভজনক বলে মনে হয়। তিনি যাজকে বহু অর্থ ও গোসম্পদ দিয়ে এই মিথুনকে ক্রয় করেন ও যাজ-উপযাজকে দিয়ে একটি কৃত্রিম যজ্ঞের আয়োজন করিয়ে পঞ্চালবাসী ও জম্বুদ্বীপের অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিলেন, দেবতার আশীর্বাদে পঞ্চালের দুই পরম শত্রু- দ্রোণ ও কুরুরাজ্যকে ধ্বংস করার বিধিলিপি কপালে নিয়ে দ্রুপদের যমজ সন্তান যজ্ঞবেদী থেকে উত্থিত হয়েছে। কুরুরাষ্ট্রের এতে কি প্রতিক্রিয়া হল, বোঝা গেল না, কিন্তু দ্রোণ ভীত হয়ে বিধির বিধানকে কার্যত সফল করার উদ্দেশ্যেই ধৃষ্টদ্যূম্নকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে উদ্যোগী হলেন।
এখন আমাদের সামনে অবধারিতভাবে উত্থিত হবে দুটি প্রশ্ন:
১) ক্রীত পুত্র পিতৃসম্পত্তির অধিকার না পেলেও দ্রুপদ কেন প্রণীত বা পরিক্রীত পুত্রের বদলে ক্রীত পুত্রের প্রতি আগ্ৰহী হলেন?
২) ক্রীত পুত্র তো মহাভারতীয় সমাজে বৈধ ছিল। তা সত্ত্বেও যাজ-উপযাজকে দিয়ে শুধু শুধু একটা যজ্ঞ করানোর কি প্রয়োজন ছিল?
এক এক করে এই প্রশ্নদুটির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি।
১) পাণ্ডু তাঁর বনবাসের সময় কুন্তীকে বলেছিলেন, শাস্ত্রানুমোদিত বারো রকম পুত্রের কথা, যাদের মধ্যে ছয় রকম পুত্র বন্ধুদায়াদ অর্থাৎ পিতৃসম্পত্তির অধিকার প্রাপ্ত এবং ছয় রকম পুত্র অবন্ধুদায়াদ অর্থাৎ পিতৃসম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। © চিন্তন দত্ত
ছয় প্রকার বন্ধুদায়াদের মধ্যে পড়ে:
ক) স্বয়ংজাত (বিবাহিতা স্ত্রীর গর্ভে স্বামী নিজের ঔরসে যে পুত্রের জন্ম দেন),
খ) প্রণীত (শ্রেষ্ঠতর বর্ণের কোন পুরুষকে নিয়োগ করলে তাঁর ঔরসে আপন পত্নীর গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হয়)
গ) পরিক্রীত (ধনরত্নের বিনিময়ে অপর কোনো পুরুষের ঔরসে আপন পত্নীর গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হয়)
ঘ) পৌনর্ভব (কোনো বিবাহিতা স্ত্রীকে যদি অন্য কোনো পুরুষ পুনরায় বিবাহ করে, তবে সেই বিবাহের ফলে সেই স্ত্রীর গর্ভে জাত সন্তানকে পরবর্তী স্বামীর পৌনর্ভব সন্তান বলা হয়)
ঙ) কানীন (কুমারী অবস্থায় কন্যার গর্ভে যে সন্তান উৎপন্ন হয়)
চ) স্বৈরিণীজ (বিবাহিত কোনো কন্যা স্বামী ছাড়া অপর পুরুষের ঔরসে যে সন্তানের জন্ম দেয়, তাকে ওই কন্যার স্বামীর স্বৈরিণীজ সন্তান বলা হয়)
ছয় প্রকার অবন্ধুদায়াদের মধ্যে পড়ে
ক) দত্ত (পিতা-মাতা যদি তাদের সন্তানকে অন্য কোনো দম্পতির কাছে দান করেন, তবে সে দত্ত)
খ) ক্রীত (অন্যের সন্তানকে অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করলে সে ক্রীত)
গ) কৃত্রিম বা স্বয়মুপাগত (কোনো শিশু আপনিই কোনো দম্পতির কাছে আশ্রয় চাইলে তাকে কৃত্রিম বা স্বয়মুপাগত সন্তান বলা হয়)
ঘ) সহোঢ় (বিবাহের সময় যদি কন্যা গর্ভবতী থাকে, তবে সেই সন্তানকে সহোঢ় বলা হয়)
ঙ) জ্ঞাতিরেতা (সহোদর ছাড়া অন্য কোনো আত্মীয় পুত্র)
চ) হীনযোনিধৃত (হীনজাতীয়া কন্যার গর্ভে জাত সন্তান)
পাণ্ডুর বক্তব্য অনুসারে এই বারো প্রকার পুত্র প্রত্যেকে তাদের পূর্ববর্তী তুলনায় হীনতর। উপরোক্ত বারো প্রকার সন্তানের পরিচয় দেখলেই আপনারা বুঝতে পারবেন, ছয় প্রকার বন্ধুদায়াদের মধ্যে কোনো প্রকারই গ্রহণ করা দ্রুপদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কেবল প্রণীত বা পরিক্রীত বাদে। আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে দ্রুপদ হয়তো যাজ বা উপযাজের কাছে প্রণীত বা পরিক্রীত পুত্রেরই কামনা করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় যাজ বা উপযাজের ঔরসে দ্রুপদের প্রণীত বা পরিক্রীত পুত্র জন্মালে তাদের বয়স হত অনেক কম, যা দ্রুপদকে দ্রোণবধ বা কুরুরাজ্য ধ্বংস- কোনোক্ষেত্রেই তেমন সাহায্য করতে পারত না, ফলতঃ দ্রুপদের আজন্মলালিত বাসনা- আর্যাবর্তের রাজনীতিকে নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসা কেবল স্বপ্ন হয়েই থেকে যেত। কাজেই ইচ্ছা না থাকলেও অবন্ধুদায়াদ পুত্র গ্ৰহণ করতে তিনি বাধ্য ছিলেন। অপরদিকে অবন্ধুদায়াদ পুত্রদের মধ্যেও দত্তক পুত্র গ্ৰহণ করতে তিনি অপারগ হলেন, কারণ আগেই বলেছি, যাজের মতো অর্থলোভী ব্যক্তি কখনোই বিনামূল্যে তাঁর সন্তানদের দ্রুপদের হাতে তুলে দিতেন না।
২) এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের দ্রুপদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে খানিকটা জানতে হবে।
দ্রুপদের পিতামহ ছিলেন সোমক। তাঁর একশত দার পরিগ্ৰহ করলেও পুত্র হয়েছিল মাত্র একটি, তার নাম জন্তু। কিন্তু একশত মায়ের একমাত্র পুত্র হওয়ায় জন্তু বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত আদরের প্রতিপালিত হয়েছিলেন। ক্রমাগত তার প্রতি আদরের আতিশয্য বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে সোমক তাঁর ঋত্বিকের পরামর্শে একটি যজ্ঞ করেন, যে যজ্ঞ করলে সোমকের একশত পুত্রসন্তান জন্ম নিশ্চিত। কিন্তু এই যজ্ঞের কঠিন বিষয় ছিল, যজ্ঞটি করতে হত জন্তুর বসা (চর্বি) দিয়ে। মহাভারত অনুসারে এই যজ্ঞের ধোঁয়া গ্রহণ করতেই সোমকের একশত রানী গর্ভবতী হন এবং জন্তুও তাঁর পুত্ররূপে পুনর্জীবন লাভ করেন। সোমকের একশত পুত্রের মধ্যে জন্তুই ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ এবং দ্রুপদপিতা পৃষত সর্বকনিষ্ঠ।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে পঞ্চালে পুত্রলাভের জন্য নানাপ্রকার যজ্ঞ করা নতুন তো কিছু ছিলই না, বরং নিঃসন্তান দশার হাত থেকে মুক্তি পেতে সেটিই একমাত্র পথ বলে মনে করা হত। পঞ্চালে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বাড়বাড়ন্তই হয়তো এর কারণ। দ্রুপদ পঞ্চালের এই সংস্কৃতিরই সুযোগ নিয়ে তাঁর পূর্বপুরুষদের পন্থা অবলম্বন করে একটি লোকদেখানো যজ্ঞ করে প্রচার করে দিয়েছিলেন, তাঁর সন্তানদের জন্ম বিশেষভাবে- সরাসরি যজ্ঞাগ্নি থেকে উঠে এসেছেন তাঁরা। যাতে করে তাঁরা রণক্ষেত্রে বা শত্রুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই তাঁদের দৈবপ্রেরিত মনে করে শত্রুর অর্ধেক ক্ষমতাই হ্রাস পেয়ে যায়। এটি পঞ্চালের দীঘদিনের প্রথা বলে হঠাৎ দু'জন পূর্ণবয়স্ক কুমার-কুমারীর আবির্ভাব কিভাবে ঘটল তা নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলির সন্দেহ করারও কোনো অবকাশ থাকত না। দ্রৌপদী-ধৃষ্টদ্যূম্নের প্রকৃত পরিচয় গোপন করার জন্যই পূর্বপুরুষদের শুরু করে যাওয়া এই প্রাচীন প্রথাটির আশ্রয় নেওয়া অত্যাবশ্যক ছিল দ্রুপদের পক্ষে।
©চিন্তন দত্ত
[ শ্রীযুক্ত চিন্তন দত্তের পোস্ট থেকে কোন বিকৃতি ব্যতীত সরাসরি উদ্ধৃত ও সর্বকৃতজ্ঞতা]
#অগ্নিজাতকের_পরিচয়
#কলমে_চিন্তন_দত্ত
0 মন্তব্য(গুলি)