https://www.idblanter.com/search/label/Template
https://www.idblanter.com
BLANTERORBITv101

মহাভাষ্য ও এর পুনঃসংস্কারের ইতিহাস

Sunday, April 23, 2023

সংস্কৃত ব্যাকরণ শাস্ত্রে ত্রিমুনি ব্যাকরণ নামে পরিচিত ব্যাকরণ গ্রন্থের মধ্যে একটি হলো মহাভাষ্য৷ এটি মূলত পাণিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ীর উপর রচিত ভাষ্য গ্রন্থ৷ আকারে বিশালতায় এবং গুরুত্বের ব্যাপকতায় এটি মহাভাষ্য নামে পরিচিত৷ তবে অষ্টাধ্যায়ীর প্রতিটি সূত্রের উপর এর ভাষ্য নাই৷ বরং কাত্যায়নের বার্তিকের সাথে সম্পর্কিত সূত্রগুলোর বিস্তারিত ভাষ্য ও আলোচনা রয়েছে এতে ৷


মহাভাষ্যের রচয়িতা হলেন পতঞ্জলি। তিনি গোনর্দীয়, গোণিকাপুত্র, চূর্ণিকার প্রভৃতি নামেও পরিচিত৷ তবে অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্যিকদের মতোই পতঞ্জলিও তাঁর বংশ ও পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। তাঁর গোণিকাপুত্র নাম থেকে অনেক বিদ্বানের অভিমত যে পতঞ্জলির মাতার গোণিকা। আবার তাঁর গোনর্দীয় নাম থেকে অনেকের ধারণা তাঁর বাসস্থান ছিল গোনর্দ নামক স্থান ৷ এছাড়াও মহাভাষ্যে (৩।২।১১৪) কাশ্মীরের উল্লেখের কারণে অনেক বিদ্বান মনে করেন তাঁর জন্মভূমি ছিল কাশ্মীর। 


পতঞ্জলির পরিচয়ের ন্যায় তাঁর সময় নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে৷ তবে পাশ্চাত্য বিদ্বানদের অনুসারে, তিনি শুঙ্গ বংশীয় রাজা পুষ্যমিত্রের সমসাময়িক ছিলেন৷ আর তাঁদের মতে, পুষ্যমিত্র শুঙ্গের রাজত্ব কাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ অব্দের দিকে৷ এই হিসেবে পাশ্চাত্য বিদ্বানগণ পতঞ্জলির সময় খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাঁদের এই কাল গণনার পেছনের যুক্তি হিসেবে তাঁরা মহাভাষ্য হতে নিম্নোক্ত বাক্যগুলো উদ্ধৃত করেছেন–


১. ❝অরুণৎ যবনঃ সাকেতম্। অরুণৎ যবনো মাধ্যমিকাম্।❞ (মহাভাষ্য ৩।২।১১১)
২. ❝পুষ্যমিত্রসভা। চন্দ্রগুপ্তসভা।❞ (মহাভাষ্য ১।১।৬৮)
৩. ❝পুষ্যমিত্রো যজতে যাজকা যাজয়ন্তি।❞ (মহাভাষ্য ৩।১।২৬)
৪. ❝ইহাধীমহে, ইহ বসামঃ, ইহ পুষ্যমিত্রং যাজয়াম।❞ (মহাভাষ্য ৩।২।১২৩)


১ম বাক্য অনুসারে, এখানে সাকেত (অযোধ্যা) এবং মাধ্যমিকা নামক নগরীতে যবন (গ্রিক) আক্রমণের উল্লেখ আছে৷ আর পুষ্যমিত্রের রাজত্বকালে ভারতে গ্রিক আক্রমণ হয়েছিল, এটি ইতিহাস বিদিত।


২য় বাক্য অনুসারে, চন্দ্রগুপ্তসভা ও পুষ্যমিত্রসভা শব্দদ্বয়ের উল্লেখ থেকে ধারণা করা হয়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও পুষ্যমিত্র শুঙ্গ পতঞ্জলির পূর্ববর্তী। 


৩য় ও ৪র্থ বাক্য অনুসারে, পুষ্যমিত্রের যজ্ঞের সময় বাক্য বক্তার ঋত্বিক হিসেবে উপস্থিত থাকার সংকেত পাওয়া যায়৷ আর ইতিহাসে পুষ্যমিত্রের অশ্বমেধ যজ্ঞ বিখ্যাত৷ পূর্বোল্লেখিত ৪র্থ বাক্যটি অষ্টাধ্যায়ীর ❝বর্তমানে লট্❞ সূত্রের ভাষ্যে পতঞ্জলি উদ্ধৃত করেছেন৷ এই সূত্র অনুসারে, বর্তমান কালে ঘটনায় লট্ বিভক্তি হবে৷ আর পতঞ্জলি পুষ্যমিত্রের যাজকত্বে লট্ বিভক্তি করেছেন৷

এসব যুক্তি ও প্রমাণের উপর ভিত্তি করে পাশ্চাত্য বিদ্বানগণ পতঞ্জলিকে পুষ্যমিত্রের সমসাময়িক অর্থাৎ দ্বিতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বলে মত প্রদান করেছেন৷ 

পাশ্চাত্য বিদ্বানদের এই মত বিচারণীয় এবং নিঃসংশয়ে গ্রহণযোগ্য নয় ৷ উপর্যুক্ত বাক্যগুলোর অন্য অর্থও করা সম্ভব৷ আবার এই অর্থগুলো যথার্থ ধরলেও পুষ্যমিত্রের রাজত্বকাল ভারতীয় পরম্পরা অনুসারে খ্রিষ্টের জন্মের শুধু ১৫০ বছর পূর্বে নয়, তা থেকে আরও বহু পূর্বে ১২০০ বিক্রমপূর্বাব্দে বলে প্রতীত হয়৷

 
আবার, ভারতীয় পরম্পরা অনুসারে, পুষ্যমিত্র বা চন্দ্রগুপ্ত বা যবন আক্রমণের এসব ঘটনা পতঞ্জলির পূর্ববর্তী না হয়ে পতঞ্জলির পরবর্তী হওয়া উচিত৷ আর যদি তাই হয়, তবে এই বাক্যগুলো পতঞ্জলির রচনা নয়, বরং মহাভাষ্যের পুনরুদ্ধারকারী চন্দ্রাচার্যের হওয়াই বেশি স্বাভাবিক৷

মহাভাষ্যের পুনরুদ্ধার ও চন্দ্রাচার্যের নাম অনেকের কাছেই নতুন। এই বিষয়ে আলোকপাত করা যাক৷
মহাভাষ্য আকৃতিতে বিশাল ও বিদগ্ধপূর্ণ গ্রন্থ হওয়ায় এটি রচিত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে এর পঠন-পাঠন হ্রাস পেতে থাকে৷ বিখ্যাত বৈয়াকরণ ভর্তৃহরি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "বাক্যপদীয়"-তে উল্লেখ করেছেন–


❝বৈজিসৌভবহর্যক্ষৈঃ শুষ্কতর্কানুসারিভিঃ।
আর্ষে বিপ্লাবিতে গ্রন্থে সঙ্গ্রহপ্রতিকঞ্চুকে॥
যঃ পাতঞ্জলিশিষ্যেভ্যো ভ্রষ্টো ব্যাকরণাগমঃ।
কালেন দাক্ষিণাত্যেষু গ্রন্থমাত্রো ব্যবস্থিতঃ॥
পর্বতাদাগমং লব্ধ্বা ভাষ্যবীজানুসারিভিঃ।
স নীতো বহুশাখত্বং চান্দ্রাচার্যাদিভিঃ পুনঃ॥❞
(বাক্যপদীয়– ২।৪৮৪,৪৮৫,৪৮৬)

 
এর মূলভাব হলো এই যে– বৈজি, সৌভব, হর্যক্ষ প্রভৃতি শুষ্ক তার্কিকগণ এই মহাভাষ্যের প্রচার নষ্ট করে দিয়েছিল৷ এই ব্যাকরণ আগম ভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে পতঞ্জলির শিষ্যদের মাধ্যমে শুধুমাত্র দক্ষিণাত্যে একটি মাত্র গ্রন্থরূপ পুঁথি সংরক্ষিত ছিল৷ পরবর্তীতে চন্দ্রাচার্য পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেই পুঁথি নিয়ে সে বহু পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাষ্যানুসারে পুনরায় সংশোধন করে সেটিকে বহুভাবে প্রচার করেছিলেন ৷

 


 


আবার ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ "রাজতরঙ্গিণী"-তেও এই তথ্যের উল্লেখ আছে৷ সেখানে বলা আছে–

❝অথ নিষ্কণ্টকো রাজা কণ্টকোৎসাগ্রহারদঃ। 

অভীর্বভূবাভিমন্যুঃ শতমন্যুরিবাপরঃ॥
চন্দ্রাচার্যাদিভির্লব্ধাদেশং তস্মাত্তদাগমম্।
প্রবর্তিতং মহাভাষ্যং স্বং চ ব্যাকরণং কৃতম্।।❞
(রাজতরঙ্গিণী ১।১৭৪, ১৭৬)

ইন্দ্রের ন্যায় তেজস্বী, নিষ্কণ্টক এবং নির্ভয় অভিমন্যু নামক রাজা ছিলেন৷ তিনি কণ্টকোৎস নামক ভূখণ্ড ব্রাহ্মণদের দানে দিয়েছিলেন। তাঁর (রাজা অভিমন্যুর) আজ্ঞায় চন্দ্রাচার্য প্রভৃতি বিদ্বান লুপ্তপ্রায় মহাভাষ্যের পুনরায় উদ্ধার ও প্রচার করেছিলেন এবং নিজের নামে চান্দ্র ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন।



এই প্রমাণসমূহ থেকে বোঝা যাচ্ছে, মহাভাষ্যের উপর শুষ্কতার্কিকগণ এমন আক্রমণ চালিয়েছিল যে মহাভাষ্যের শুধু একটি মাত্র পুঁথি দক্ষিণাত্যের পার্বত্য অঞ্চলে অবশিষ্ট ছিল৷ আর একটি মাত্র পুঁথির মাধ্যমে মহাভাষ্যের মতো বিশাল গ্রন্থের পাঠসংশোধন কঠিন একটি কার্য৷ এই কার্যকালে পুঁথি থেকে কিছু অংশ লুপ্ত হওয়া বা হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। আর সেই অংশ ভাষ্য অনুসারে চন্দ্রাচার্যের মতো অপর এক বিখ্যাত বৈয়াকরণ দ্বারা পুনঃলিখিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়৷

এজন্য এখনো মহাভাষ্যে কিছু ভ্রষ্টপাঠ পাওয়া যায়৷ যেমন– 

মহাভাষ্য ৮।৪।৪৭ এর মহাভাষ্যপ্রদীপ নামক টীকায় কৈয়ট বলেছেন, ❝'নায়ং প্রসজ্যপ্রতিষেধঃ' ইতি পাঠোঽয়ং লেখকপ্রমাদান্নষ্টঃ।❞ অর্থাৎ মহাভাষ্যে 'নায়ং প্রসজ্যপ্রতিষেধঃ' পাঠ লেখক প্রমাদে নষ্ট হয়েছে



আবার, সংস্কৃত সাহিত্যে এরকম গ্রন্থের লুপ্ত অংশের স্থানে পরবর্তী সংশোধক বা পুনঃপ্রচারকর্তা নিজের বৈদগ্ধতা অনুসারে পাঠ তৈরি করে গ্রন্থের পরিপূর্ণতা প্রদানের ঘটনা বিরল নয়৷ যেমন– চরকসংহিতার সংশোধক হিসেবে দৃঢ়বলের নাম উল্লেখযোগ্য৷ দৃঢ়বল যখন চরকসংহিতা পুনঃসংস্কার করেছিলেন, তখন চরকসংহিতার চিকিৎসাস্থানের ১৩ অধ্যায়ের পর থেকে ৪০ অধ্যায় পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গেছিল৷ তখন দৃঢ়বল নিজে এই লুপ্ত অধ্যায়গুলো রচনা করেছিলেন৷ চরকসংহিতার সিদ্ধিস্থানে (১২।৬৬–৬৮) দৃঢ়বল নিজে এই তথ্য উল্লেখ করেছেন– 

❝অতস্তন্ত্রোত্তমমিদং চরকেণাতিবুদ্ধিনা। 

সংস্কৃতং তত্ত্বসম্পূর্ণং ত্রিভাগেনোপলক্ষ্যতে। 

তচ্ছঙ্করং ভূতপতিং সম্প্রসাদ্য সমাপয়ৎ। 

অখণ্ডার্থং দৃঢবলো জাতঃ পঞ্চনদে পুরে।❞

 



একইভাবে চন্দ্রাচার্যের দ্বারা মহাভাষ্যের অংশবিশেষও লিখিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়৷ অনেক গবেষকের ধারণা পূর্বোল্লিখিত পুষ্যমিত্রের নামযুক্ত অংশগুলোর রচয়িতা পতঞ্জলি নন, বরং চন্দ্রাচার্য৷ 


এখন প্রশ্ন হতে পারে, সেই চন্দ্রাচার্যের জীবনকাল কখন? এই প্রসঙ্গে রাজতরঙ্গিণীতেই বলা হয়েছে–


❝তদা ভগবতঃ শাক্যসিংহস্য পরনির্ব্রুতেঃ। অস্মিন্মদীরোকধাতৌ সার্ঘে বর্ষশতং হ্যগাৎ॥❞
(রাজতরঙ্গিণী ১।১৭২)

তখন ভগবান শাক্যসিংহের (বুদ্ধের) নির্বাণ প্রাপ্তির একশত পঞ্চাশ বছর অতীত হয়েছিল ৷

অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের নির্বাণের ১৫০ বছর পর রাজা অভিমন্যু কাশ্মীরের রাজত্ব গ্রহণ করেছিলেন৷ আর গৌতম বুদ্ধের জন্মকাল নিয়েও মতভেদ আছে পাশ্চাত্য, ভারতীয় ও চৈনিক পরিব্রাজকদের মধ্যে৷ কিন্তু বুদ্ধের নির্বাণের সময়ের সাপেক্ষে তার থেকে প্রায় ১৫০ বছর পর চন্দ্রাচার্য মহাভাষ্য পুনঃসংস্কার করেছিলেন৷