পূর্বপক্ষঃ
আপনারা সাংখ্য হতে যে ঈশ্বর তত্ত্ব দেখান তা মিথ্যা। সাংখ্য নিরীশ্বর
দর্শন এবং সাংখ্যসূত্রকার স্বয়ং বলেছেন, “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ” ঈশ্বরের
অসিদ্ধিদোষ রয়েছে।
সিদ্ধান্তীঃ
আপনি অন্যায়ভাবে পরমর্ষিকপিল রচিত সাংখ্যদর্শন হতে একটা সূত্র নিয়ে তার
অপব্যাখ্যা করছেন। আপনি যদি পূর্বাপর সূত্র দেখেন তবে আপনার এই ভ্রান্তি
নাশ হবে। প্রথমে আমরা প্রকরণ অনুযায়ী দেখি এখানে আসলে কী বলার জন্য এই
সূত্রের আবির্ভাব হয়েছে।
“.....ত্রিবিধং প্রমাণম্॥১/৮৭॥”
সূত্রকার
বললেন প্রমাণ তিন প্রকার, যথা: প্রত্যক্ষ, অনুমান, আগমঃ।
“তৎসিদ্ধৌ সর্বসিদ্ধের্নাধিক্যসিদ্ধিঃ॥১/৮৮॥”
এই ত্রিবিধ প্রমাণেই সব সিদ্ধান্তের
সিদ্ধি হয়।
এখন
তিনি যে বললেন, “তার নেওয়া ত্রিবিধ প্রমাণের দ্বারা সব প্রমাণের সিদ্ধি
হয়”, এর পুষ্টিকরণ করছেন। কেননা দর্শন পরম্পরায় কোনো সিদ্ধান্ত দিলে তার
পক্ষে যুক্তি দেওয়া আবশ্যক।
তিনি প্রত্যক্ষ প্রমাণ সম্বন্ধে বলেছেন,
যৎসম্বন্ধসিদ্ধং তদাকারোল্লেখিবিজ্ঞানং “তৎপ্রত্যক্ষম্ ॥১/৮৯॥”আত্মার সহিত যেকোনো পদার্থের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া এবং সেই বস্তুর স্বরূপকে প্রকটকারী যে জ্ঞান, তাকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে।
[জ্ঞান আত্মায় সরাসরি হোক বা ইন্দ্রিয় দিয়ে হোক, উভয়রূপে প্রাপ্ত জ্ঞানই প্রত্যক্ষ প্রমাণ]
এখন,
অনেকেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলতে শুধু পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত
জ্ঞানই নেন। কিন্তু এমনটা ভাবা অনুচিত এবং ত্রুটিযুক্ত। কারণ যোগী
অসমপ্রজ্ঞাত সমাধিতে ঈশ্বরের আন্তরিক প্রত্যক্ষ করেন। এবং এই সিদ্ধান্ত না
মানলে শ্রুতিও অমান্য হবে। শ্রতিতে বলা হয়েছে,
“ত্বমেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্মাসি। ত্বামেব প্রত্যক্ষং ব্রহ্ম বদিষ্যামি”অর্থঃ হে ঈশ্বর! আপনি প্রত্যক্ষ ব্রহ্ম। আমি আপনাকে প্রত্যক্ষ করে আপনার ব্যাখ্যা করবো, আপনার বিষয়ে বলবো।
তাই,
“যোগিনামবাহ্যপ্রত্যক্ষত্বান্ন দোষঃ ॥১/৯০॥”যোগীর আন্তরিক প্রত্যক্ষও পূর্ব সূত্রে বর্ণিত প্রত্যক্ষ লক্ষণে সংগ্রহীত হওয়ায় পূর্বক্ত প্রত্যক্ষ লক্ষণে দোষ নেই।
এবং
লীনবস্তুলব্ধাতিশয়সম্বন্ধাদ্ বাঽদোষঃ ॥১/৯১॥
যোগীদের সূক্ষবস্তুর সাথে সরাসরি সম্বন্ধ হয় এজন্য পূর্বক্ত পরিভাষায় কোনো দোষ নেই।
সূত্রকার
বলছেন, যদি তিনি পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের পাশাপাশি যোগীর আন্তরিক
প্রত্যক্ষকেও না নিতেন তবে প্রত্যক্ষ প্রমাণে
“ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ॥১/৯২॥”
ঈশ্বরের অসিদ্ধি হতো।
কিন্তু
তিনি যেহেতু পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাথে যোগীর আন্তরিক দর্শনকেও নিয়েছেন,
সেহেতু তার বর্ণিত প্রত্যক্ষ লক্ষণে ঈশ্বর অসিদ্ধি হওয়ার দোষও নেই।
তাহলে
প্রকরণের উপসংহারে আমরা দেখতে পাই, সূত্রকার তার বর্ণিত প্রত্যক্ষ
প্রমাণের পুষ্টিকরণের জন্য বলেছেন, “তার বর্ণিত সংজ্ঞা গ্রহণ না করলে
প্রত্যক্ষ লক্ষণে ঈশ্বরের অসিদ্ধি হবে।” সুতরাং এটা নিশ্চিত যে পরমর্ষি
কপিল ঈশ্বরবাদী কেননা তিনি এমনভাবে প্রত্যক্ষ প্রমাণের সংজ্ঞা তৈরী করেছেন,
তাহাতে ঈশ্বরেরও প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারাও সিদ্ধ হয়, যা শ্রুতি সম্মত।
এই হলো “ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ” সূত্রের সংক্ষিপ্ত অর্থ।
পূর্বপক্ষঃ
মেনে নিলাম সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বর তত্ত্বকে মানা হয়েছে, কিন্তু তা বৈদিক
ঈশ্বর নয়। অনিত্য ঈশ্বর মানা হয়েছে, যিনি হলেন পূর্ব কল্পের শ্রেষ্ঠ জীব।
সিদ্ধান্তীঃ আপনার একথাও মিথ্যা অপবাদ।
সাংখ্যে ঈশ্বর নিত্যমুক্ত
“নিত্যমুক্তত্বম্ ॥১/১৬২॥”
অন্যদিকে জীব নিত্যমুক্ত নয়। কর্মফল অনুযায়ী মুক্ত, বদ্ধ হওয়ায় সে উভয়রূপী।
“ব্যাবৃত্তোভয়রূপঃ ॥১/১৬০॥”
ঈশ্বরকে
নিত্যমুক্ত বলা হয়েছে, তাই পূর্ব কল্পের শ্রেষ্ঠ জীব পরের কল্পে ঈশ্বর
হবে, এমন ভাবনা সাংখ্য বিরুদ্ধ। এমনকি সাংখ্যের সমশাস্ত্র যোগ দর্শনের
সমাধিপাদের ২৪ নং সূত্রের ভাষ্যে মহর্ষি ব্যাসদেব লিখেছেন,
“স তু সদৈব মুক্তঃ সদৈবেশ্বর ইতি।”
তিনি সব সময় মুক্ত, তাই তিনি নিত্য ঈশ্বর।
তারপর ঈশ্বর সম্বন্ধে সাংখ্যে বলা হয়েছে,
স হি সর্ব্ববিৎ সর্ব্বকর্ত্তা ॥৩/৫৬॥ঈদৃশেশ্বরসিদ্ধিঃ সিদ্ধা ॥৩/৫৭॥
সেই ঈশ্বর সর্বজ্ঞ সর্বকর্তা।
এমন সর্বজ্ঞ সর্বকর্তা ঈশ্বর সিদ্ধ।
সর্ববিৎ
হিসেবে শ্রুতিতে নিত্য ব্রহ্মকেই নির্দেশ করা হয়েছে (ঋক ৮/১০১/১৪,
১০/৭১/৩; যজু ৩২/১০) তাই এই স্থলে জীব কল্পনা করা দোষযুক্ত। আবার স্বল্প
ক্ষমতাধর জীব কখনো সর্বকর্তা হতে পারে না, সর্বকর্তা হিসেবে জীব ভিন্ন
ঈশ্বরকেই গ্রহণ করতে হবে।
শ্রুতি শাস্ত্রে বর্ণিত নিত্য, সৎ, সর্বজ্ঞ, সর্বকর্তা ঈশ্বরই সাংখ্য দর্শনে বর্ণিত হয়েছে।
যোগ দর্শনের ব্যাসভাষ্যেও এমনটাই বর্ণিত হয়েছে,
“পূর্বপক্ষঃ কৈবল্যপ্রাপ্ত হয়েছেন সেভাবের অনেক কেবলী পুরুষ রয়েছেন।
সিদ্ধান্তীঃ তাঁরা কিন্তু মাত্র তিন প্রকার বন্ধন ছিন্ন করে কেবলীভাব প্রাপ্ত হয়েছেন;
পূর্বপক্ষঃ তাঁদেরও কি ঈশ্বর বলা যায়?
সিদ্ধান্তীঃ
ঈশ্বরের কিন্তু সে রকম সম্বন্ধ অতীতে হয়নি, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। মুক্ত
পুরুষের পূর্ববন্ধকোটি যেমন জানা যায়, [পূর্বে বদ্ধ ছিলেন এখন মুক্ত, এ
ভাবের ব্যাপার] ঈশ্বরের তেমনি নেই। আরও যেমন প্রকৃতিলীন পুরুষের ভবিষ্যতের
বন্ধন ব্যাপারের অর্থাৎ উত্তরবন্ধনের ব্যাপারের সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি
ঈশ্বরেতে ঘটে না।
তিনি তাই সব সময় মুক্ত, তাই তিনি সদা ঈশ্বর।”
অতঃ আপনার এই “এক কল্পের জীব পরের কল্পের ঈশ্বর হওয়ার দাবী সাংখ্য দর্শন ও বেদাদী শাস্ত্র দ্বারা মিথ্যা প্রমাণিত হলো।”
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
0 মন্তব্য(গুলি)